Monday, August 30, 2021

সংশোধন আর সম্বোধন এক কথা নয়...

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ : পর্ব-০২
নিগার, 
সেন্টমার্টিন। হোটেল প্যারাডাইসের বারান্দা বসে যখন সমুদ্রের সাথে চাঁদের জোসনার মিতালী উপভোগ করতে ছিলাম তখন তুমি আমার ডান ঘাড়ের উপর দুই হাত রেখে কানের কাছে যে আর্তনাথ প্রকাশ করে ছিলে সে কথা নিশ্চয় এখনো ভুলে যাওনি? 
সমুদ্রের হিমশীতল বাতাস যখন তোমার শরীরকে ক্রমশ: ক্লান্ত করে ছিল তখন কাঁপতে কাঁপতে আমার শার্টের বোতাম খুলে নিজের মুখটা আমার বুকে লুকিয়ে নিঃশ্বাস নিতে চেয়ে ছিলে। তা কি আজও মনে পড়ে?
গভীর রাত পর্যন্ত আমরা সাগর পাড়ে এক ফুট ব্যবধানে যখন বসে তোমার করুণ জীবনের গল্প আমাকে শোনাতে শোনাতে দূরত্বের ব্যবধান কমিয়ে তোমার ডান হাতটা আমার পিঠের উপর দিয়ে পেটের ডান পাশে রেখে নিজেকে আমার মাঝে বিসর্জন দিতে- এটা মনে হয় কোন কাল্পনিক দৃশ্য নয়? 
কি ভুলে গেলে সেই কথা- যার কন্ঠস্বর তোমার কানের পর্দা স্পর্শ না করলে ঘুমতে পারতে না। আমার সেই চিরাচিত স্বভাব ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ না বললে তোমার দু’চোখের পাতা এক হতো না? 
নিশ্চয় এটা অবিশ্বাস করবে না- আমিই তোমার জীবদ্দশায় একমাত্র ব্যক্তি ‘যে আঘাত নয় বরং আঘাতের চিহ্নে চুম্বন খেয়ে সুখে এনে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম’। কি ভুলে গেলে সেই কথা? নাকি এসব বাক্য শুধু ভিউয়ার্সের মনোরঞ্জন মাত্র!
যাক, যা মনে করেন। মূল কথায় আসি। 
কাউকে সম্বোধন করার পূর্বে একটু ভেবে নিবেন তার সাথে আপনার সর্বশেষ সম্পর্ক কি। তার পর সেই সর্বশেষ সম্পর্কের উপর নির্ভর করে ঐ ব্যক্তিকে সম্বোধন করবেন। কাউকে তিরস্কার করে কিংবা ব্যাঙ্গ করে কথা বলার অধিকার নিশ্চয় কেউ কাউকে দেয় না। 
ভালো থাকার কারণ; জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরটা খুব সহজ (!) একটা লোক সম্পর্কে আপনাকে সর্তক করেছিলাম। বারণ করেছিলাম ওর সাথে না যেতে। ওয়াদাও করেছিলেন আর কখনো যাবেন না। 
যখন প্রমাণ দিলাম ‘যে আপনি ওয়াদা’ ভঙ্গ করেছেন। তখন আপনি একটি ভয়েজ ইউজ করেছিলেন। মনে করতে পারেন সেই ভয়েজ থেকে আমি আমার ভালো থাকা শিখে গেছি।  

Thursday, August 19, 2021

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ : পর্ব-০১

 হৃদয়ে রক্তক্ষরণ : পর্ব-০১

নিগার,
শরৎ এসেছে। কাঁশবন এখনো সাদা মেঘের ভেলায় রূপ নেয়নি। কিন্তু মনটাতে বর্ষার কালো মেঘের ঘনঘটা। সত্যি বলতে কি! তোমাকে বিরক্ত করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা ছিল না। যতটা আঘাত বুকের ভেতরে জমা রেখে চলে গেছো, সেখান থেকে তোমার প্রতি কোন অক্ষর প্রকাশিত হবে তা আমার মনের ঘরে জমা নেই।
তবে তোমাকে মনে পড়ার একটা কারণ হলো- যখন তুমি স্বার্থপরের মতো চলে যাও, তখন কিছু দিকনির্দেশনা আমাকে দিয়ে ছিলে। আর বলে ছিলে, এগুলো কখনো করতে যেও না। তাহলে তুমি শুধু আঘাত পাবে, হয়তো সে আঘাত তোমাকে নিঃশেষ করে দিবে। তুমি অল্পতেই মানুষকে বিশ্বাস করো। যা কখনো ঠিক নয়; মনে রাখবে হাসির মাঝেও স্বার্থের ছায়া থাকতে পারে। তিনটি চাওয়ার মধ্যে একটি ছিল এরকম। আমি তোমার কাছে ওয়াদা করিনি তবে, ভেবে ছিলাম তোমার তিনটা চাওয়া আমি রক্ষা করবো। যেখানে তোমার নয়; আমার স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ জড়িত।
নিগার,
স্বভাবে যে চোর। সে অনেক অভিনয় করতে পারে। ক্ষুধার অভিনয়। পেট ব্যাথার অভিনয়। মাথা ব্যাথার অভিনয়। অজ্ঞান হওয়ার অভিনয়। কথিত চোর যে অভিনয়ই করুক না কেন; তার উদ্দেশ্য থাকে একটাই কাঙ্খিত জিনিসটি চুরি করে হাতিয়ে নেয়া। আমরাও মানব জাতি কিছু অভিনয়কে এমনভাবে বিশ্বাস করে ফেলি; যখন নিজের কোন কিছু খোয়া যায় তখন বুঝি বিশ্বাসের ঘরে চুরি হয়েছে। একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয়া-ফেলা ছাড়া কোন কিছু করার থাকে না। 
ছোট একটা গল্প শোন, আমার বন্ধু নিলয়ের বাড়ি কুয়াকাটা সাগর পাড়ে। ঝড়-তুফান আর জলচ্ছাসের মধ্যে বসবাস। অবসর সময় পেলে সে সাগরে মাছ ধরে। সম্প্রতি নিলয় তার এক বন্ধুর বৌদলতে রাজশাহী গিয়েছে আম কিনতে। সে নাকি আমের ব্যবসা করবে। এখন নিলয় অনলাইনে মালেয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, বাহরানে আম সরবরাহ করছেন। চিন্তা-চেতনা আর পোশাকে মনে হয় না; নিলয় সাগর পাড়ের ছেলে। আগে তার কার্যকলাপে তাকে আমি নেরুমাইন্ডের লোক বলে ক্ষ্যাপাতাম। সে রাগও করতো না। কারণ- তার মধ্যে নেরুমাইন্ডের উপাদানগুলো বিদ্যমান ছিল। আজ তার সাথে কথা হলো- কথা প্রসঙ্গে নিলয় আমাকে একটা উচিত শিক্ষাটা দিল। উল্টো নিলয় আজ আমাকে বললো- আমি এখন ভরাটমাইন্ডের লোকদের সাথে চলাফেরা করি। আমাকে নিরুমাইন্ডের লোক বলবি না! 
আসলে প্রতিউত্তরে নিলয়কে কিছু বলার নেই। আমি তাকে নেরুমাইন্ডের লোক হিসেবে জানতাম; আর তা নিলয় বিশ্বাস করতো বলে; সে আজ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে এখন নেরুমাইন্ড থেকে ভরাটমাইন্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে। নিলয়ের ভাষ্য থেকে এটাই আমার বড় প্রাপ্তি কিংবা স্বার্থকতা- ‘সে যে নেরুমাইন্ডের লোক ছিল; সেটা আজও স্বীকার করলো। 
নিগার,
মনে মনে ভাবছো, এ গল্প শোনানোর জন্য আমার পেছনে এত সময় ব্যয় করার কি দরকার ছিল? ‘তার কি কোন খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই?’। তোমার ভাবনাতে আমি দ্বিমত পোষণ করবো না। তবে এ গল্পের মধ্যে লুকিয়ে আছে অদৃশ্য একটি চরম সত্য উপলব্ধি। লেখাটা পড়ার পর রাতে যখন ঘুমতে যাবে, তখন মনে মনে চিঠি-টাকে স্মৃতিচারণ করতে চেষ্টা করো। তাহলে কিছুটা হলেও তোমার হিসাব মিলবে। আর যদি নাই হিসাব মিলে তাহলে বেশিক্ষণ সময় ব্যয় করো না। অন্য কাজে মন দিও। মন-শরীর দুটোই ভালো থাকবে। অন্য আরেকদিন না হয় অদৃশ্য চরম সত্যটা নিয়ে লিখবো।
ইতি,
যে নামে তুমি জানো...

আগষ্ট মাসের চিঠি-০২

 আগষ্ট মাসের চিঠি-০২

... নাজমুল করিম ফারুক
মেঘশ্রী,
তোমাকে নিয়ে লেখতে গেলে লেখা শেষ হয় না। কিন্তু বেশি লেখাতে বেশি বিভেদ-বিচ্ছেদ ঘটায়। তোমাকে যেন চিঠি না লিখি প্রথম থেকে বারণ করা আছে। আজকের ডিজিটাল (ইমু, হোয়াটঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনবক্সে) যুগে এত লম্বা চিঠি পড়ার ধর্য্য কারো থাকে না। তার পরও লেখতে হয়।
জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুলিশের এক সদস্য প্রকাশ্যে গুলি করে একজন শিশু, নারী, পুরুষ তিনজনে হত্যা করেছিল। সেদিন বিকালেই লেখতে চেয়েছিলাম। যখন লেখতে বসলাম তখন মিডিয়ায় খবর ছড়িয়ে গেল ‘পরীমণির লঙ্কাকান্ড’। কি যে কান্নাকাটি! বোর্ড ক্লাবে উনার সাথে ‘কি যেন’ ঘটে গেছে। যাক পরে আর লেখতে পারলাম না। দীর্ঘদিন আর লেখাতে মন বসেনি। হেলেনা, পিয়াসা, মৌ আর পরীমণিদের রঙ্গশালার দৃশ্যপট লেখার আগ্রহ নিমেষ করে দিয়েছে।
তিন কিংবা চারদিন আগে দুপুর বেলায় দেখলাম পশ্চিম আকাশে রংধনু পাখা মেলেছে। পশ্চিম আকাশে রংধনুর এমন উদয় দ্বিতীয় বারের মতো আমার চোখে পড়েছে। একটা গল্পের ইতিহাসের দৃশ্যপট অনেক ভাবে পরিবর্তন হয়। যেমনটা হচ্ছে আজ। তাই আজ আপনি বলে সম্বোধন করতে যাচ্ছি। কারণ- কথায় কথায় যখন আপনার মুখের ভাষা থেকে বিশ্রী গন্ধ বের হয়; মানুষকে পশুর মতো ভাবতে থাকেন, তখন চেনা মুখটাও অচেনা হয়ে যায়। এটা নতুন কিছু নয়।
শিক্ষা নাকি মানুষকে ভদ্রতা, ন¤্রতা, শিষ্টাচার শেখায়? আপনার সাথে কথা বললে তার লেশমাত্র পাওয়া যায় না। সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন? বড় শয়তানগুলোর সাথে ছোট শয়তান যুক্ত হলে এখানে পন্ডিত্বের পাল্লাটা ভারি হয়ে যায়। হাজার হাজার বাটখেরা দিলেও কোন কাজ হয় না। যাক, এদিকে আর যেতে চাই না। আপনার যেমন আমার, আমার সংস্পর্শ সকলের প্রতিটি কথা মনে মনে আছে, তেমনি আপনার ও আপনার সংস্পর্শ সকলের কথাও আমার মনে মনে আছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকবে। ইনশাআল্লাহ।
একটা নতুন খবর না দিলে নিজের ভেতর অতৃপ্তি থেকে যাবে। বেশ কয়েক মাস আগ থেকে নতুন একজনের আগমন ঘটেছে। আমার জরার্জীণ কুটিরের দরজায়। আলিসা। ওরফে আলিসা জেরিন। এখন আমি তাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত। এতটাই ব্যস্ত যে, আগামী ৪/৫ মাসের মধ্যে যদি একটা ব্যবস্থা করতে না পারি। তাহলে এতদিন বুকের ডান পাজরে যে ব্যাথাটা অনুভব হয়ে আসছে তা বামপাশেও ছড়িয়ে যাবে।
দোয়া করবেন। মেঘশ্রী নামের মেঘবিহীন আকাশে যেন আলিসা ‘সৎ কিংবা সত্যবাদী’ রূপে আলোকিত হয়।

Sunday, October 11, 2020

সবুজ ঘাসের নিপুণ কার্পেট গুলিয়াখালী সী বীচ 
নাজমুল করিম ফারুক


প্রচন্ড গরমে কোনো কিছুতেই মন বসছে না। হঠাৎ প্লান হলো সীতাকু- যাবো। দর্শনের তালিকা কর্ষতে গিয়ে সকালে মহামায়া লেক, দুপুরটা চন্দ্রনাথ পাহাড় আর বিকালটা কাটাবো দেশের সেরা সবুজ ঘাসের নিপুণ কার্পেট গুলিয়াখালী সী বীচে। এমনটা মাথায় নিয়ে কুমিল্লার তিতাস থেকে ভোর ৫টায় মাইক্রোবাসে রওনা দিলাম আমিসহ মনির মুন্সি, শাহআলম, শেখ ফরিদ, ইকবাল হোসেন, তাজুল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, মোশারফ হোসেন, শামীম হোসেন ও বিজয়।

সকাল সাড়ে ৯টায় মহামায়া লেক। ঘুরাঘুরি আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারপর গাড়ি সোজা চন্দ্রনাথ পাহাড়; স্থানীয়দের ভাষায় সীতাকু- পাহাড়। চট্টগ্রাম জেলা শহরের সবচেয়ে উচুঁ পাহাড়টির উপরে অবস্থান চন্দ্রনাথ মন্দির। এ মন্দিরকে হিন্দুদের বড় তীর্থস্থান বলা হয়ে থাকে। সীতাকুন্ড বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বদিকে চন্দ্রনাথ পাহাড়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চন্দ্রনাথ শৃঙ্গ প্রায় ১০২০ ফুট বা ৩১০ মিটার। পাহাড়ের পাদদেশে নবনির্মিত তোরনের সামনে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে এক পথে পাহাড়ে উঠা; আরেক পথে পাহাড় থেকে নেমে আসার ইতিহাসটা যতটা না আনন্দদায়ক তার চেয়ে বেশি কষ্টের। প্রচন্ড গরম মাথা নিয়ে আমাদের মতো নাছোরবান্দা ছাড়া কেউ কি পাহাড় ট্রেকিংয়ে যায়? যাক, বিকাল ৩টার মধ্যেই সীতাকুন্ড বাজারে এসে দুপুরের খাবার শেষ করে গুলিয়াখালী সী বীচের দিকে রওনা দিলাম।  

সীতাকুন্ড বাজার থেকে বাইপাসের নিচ দিয়ে মুরাদপুরের রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। সীতাকুন্ড বাজার থেকে প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার দূরে মুরাদপুর বা গুলিয়াখালী সী বীচ। গ্রামের ভেতর দিয়ে সরু রাস্তা হওয়া কিছুটা বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুটি অটোরিক্সা ক্রোস করার মতো রাস্তা নয়; তার উপর মাইক্রোবাস। তারপরও অচেনা গন্তেব্যের আনন্দটা বুক থেকে মোটেও সরে যাচ্ছে না। মুরাদপুর গ্রাম সংলগ্ন বেড়িবাঁধ। গাড়ি থেকে নেমে বেরিবাঁধে উঠেই চোখে পড়ে মাথার উপর বিশাল আকাশ, তার নিচে কেওড়ার বন, খানিক দূরে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি। বীচের প্রান্ত এমন ভাবে আমাদের ডাকছে- দেরি না করে ছোট খালে ইঞ্জিল চালিত নৌকায় চড়ে বীচের কাছে। 

ছোট খালের একদিকে কেওড়ার বন, অপরদিকে সবুজ ঘাসের নিপুণ কার্পেট। পাহাড়ের ন্যয় ছোট ছোট টিলাগুলো সবুজ ঘাসের বিছানায় সজ্জিত বীচকে এতটা অনিন্দ্যসুন্দর করে তুলেছে নিজ চোখ না পড়লে কখনও অনুভুব করা যাবে না। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ক্লান্ত দেহটা ঝিরিঝিরি বাতাসে কখন দূর হয়ে গেলো টেরও পেলাম না।

এককথায়, সৈকতটির জীবপ্রকৃতির বৈচিত্রের অনিন্দ্যরূপের কারণেই সকলের কাছে প্রিয়। চারদিকে সবুজ আর সবুজ, মাথার ওপর বিশাল আকাশ, মাটিতে একপাশে কেওড়ার বন, তার মাঝ দিয়ে খাল, খালের এদিক-ওদিক চারদিকে ছড়িয়ে আছে কেওড়ার শ্বাসমূল, যেন আরেক ম্যানগ্রোভ বন। আর সামনে বিশাল জলরাশি। জোয়ার-ভাটার খেলা। সমুদ্র সৈকতের বালুভূমি আর চার পাশের মোহনীয় রূপে মোহবিষ্ট হচ্ছে দর্শনার্থীরা। সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে বীচটিতে দর্শনার্থীদের আনাগোনাই তার প্রমাণ মেলে। কি অপূর্ব দৃশ্য! সমুদ্রের জলে সূর্যের রক্তিম আভা। জল আর আকাশ মিলেছে সোনালি রঙের ক্যানভাসে।

যারা চট্টগ্রাম বা সীতাকুন্ড ঘুরতে যাবেন, বিকালে সময়টা রেখে দিবেন গুলিয়াখালী সী বীচের তালিকায়। সারাদিনের ক্লান্তিটা দূর করার এমন অনুভূতি আমি কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা বা পতেঙ্গাতেও পায়নি। বিশ্বাস না হলেও সময় করে ঘুরে আসতে পারেন গুলিয়াখালী সী বীচে।  
যাতায়াত :
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুন্ড বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি, অটোরিকশা নিয়ে যাওয়া যাবে গুলিয়াখালি সমুদ্র সৈকতে। স্থানীয়রা গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতকে মুরাদপুর বিচ নামে চেনেন। ভাড়া লাগবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। রাস্তাটি সরু হলেও বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে। দিনের যে কোন সময় উভয় প্রান্ত থেকে সিএনজি অটোরিক্সা পাওয়া যায়।  
থাকা ও খাওয়া : 
গুলিয়াখালি সমুদ্র সৈকতের আশে-পাশে থাকা ও খাওয়ার কোনো ভাল ব্যবস্থা নেই। খেতে হলে সীতাকুন্ড বাজারে খেতে হবে। বাজারে মোটামুটি সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়। বাজারেই রয়েছে সৌদিয়া আবাসিক হোটেল, গ্রীণ হোটেল, সাইমুনসহ কয়েকটি রেস্ট হাউজ।

লেখক,
নাজমুল করিম ফারুক
সভাপতি : তিতাস উপজেলা প্রেসক্লাব
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা।
মোবাইল ঃ ০১৮১৮-০০৪২৭২

Wednesday, September 30, 2020

                                      অসাধারণ এক বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’
... নাজমুল করিম ফারুক


আমি কি করবো তা বুঝতে পারি না। টাকার জন্য আমি চুরি ডাকাতি করতে গেছি, আমি অনায়াসে নিয়েছি মানিক সাহার চার নম্বর বউ ঝুমুরকে। আমার গোটা জীবনে কোনো নৈতিকতা নেই। উপরন্তু আমার আছে কালব্যাধির মতো একটা খিদে। যখন খিদে মিটে যায় তখনো আবার খিদের চিন্তা থাকে, ভয় থাকে। ক্যানসারের মতো, কুষ্ঠের মতো সেই খিদে কখনো সরে না।
আমার বিবেক তার বাদ্যযন্ত্রে একটা পিড়িং শব্দ তুলে বলে- এখনো অনেক টাকা রয়ে গেল তোমার উপলচন্দোর। তুমি যে হ্যান্ডবিলের মতো টাকা ওড়াতে চেয়েছিলে। 
ঠিক। ঠিক। আমি মাথা নাড়ি। 
একমুঠো টাকা বান্ডিল থেকে খুলে এনে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিই বাইরে। ঠিক অবিকল হ্যান্ডবিলের মতো বাতাসের ঝটকায় টাকা উড়ে যায়। ঘুড়ির মতো লাট খায় শুন্যে। তার আলোকিত রাস্তাঘাট আর মানুষজনের উপর নেমে আসে। 
গাড়ীর পেছনের কাঁচ দিয়ে আমি ঘুুরে দেখি। মানুষজন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দৌঁড়াচ্ছে টাকার দিকে। চলন্ত ট্রাম বাস থেকে নেমে পড়ছে রাশি রাশি মানুষ। একটা লোক চলন্ত গাড়ির নীচে চলে গেল টাকা কুড়োতে গিয়ে। 
আর এক মুঠো উড়িয়ে দিই। দেখি। দোকান ছেড়ে নেমে আসছে দোকানী। হাড়কাটা গলির ভাড়াটে মেয়েরা খদ্দের ভুলে পিলপিল করে রঙিন মুখ আর তেল-সিঁদুরের ছোপ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। একটা ঠ্যাং ভাঙা লোক টানা রিক্সায় বসে মেডিকেল কলেজে যাচ্ছিল, সে হঠাৎ দু’পায়ে লাফ মারল রাস্তায়। 
বৌবাজারের মোড় পেরিয়ে আর একমুঠো ওড়াই। 
ট্যাক্সিওয়ালা ট্যাক্সি থামিয়ে বলে- কি হচেছ বলুন তো পিছনে?
- কিছু না। আপনি চলুন।
ট্যাক্সিওলা আবার গাড়ি ছাড়ে। আমি টাকা ওড়াতে থাকি। আমার পিছু পিছু কলকাতা পাগল হতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি ভুলে লাফিয়ে পড়ে রাস্তায়। সিনেমা ভেঙে যায়। দোকানে বাজারে ঝাঁপ পড়তে থাকে। দাঙ্গা লেগে যায়। ট্র্যাফিক জ্যাম সৃষ্টি হতে থাকে। একটা কালো পুলিশের গাড়ি ধেয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। আমি পাত্তা দিই না। চৌরঙ্গীর মোড়ে আমি মহানন্দে টাকা ছড়াই। 
টাকা ওড়ে। লট খায়। পড়ে। 
(খিদের ভয়কে জয় করে গল্পের মূল চরিত্র উপল অর্থ্যাৎ উপলবাবু টাকা উড়িয়ে সারা কলকাতাতে লংঙ্কাকান্ড ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে)।  

ক্ষণা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল- তুমি ছাড়া আর কেউ কখনো আমাকে এত সুন্দর দেখেনি। কখনো বলেনি- তুমি বড় সুন্দর। 
-তুমি সুন্দর ক্ষণা। বলে ক্ষণার কোমরের দিকে হাতটা আলতোভাবে জড়াই। বলি- সকলের কি সৌন্দর্য দেখবার চোখ থাকে?
ক্ষণা অন্যমনষ্ক বসে রইল একটু। তারপর বলল- তোমার বন্ধু কখনো আমাকে সুন্দর দেখে না। ও আমাকে দেখলই না ভাল করে, নিলও না। বিয়ের পর থেকেই দেখছি, ও বড় কাজের মানুষ। আমরা হানিমুনে যাইন, এমন কি সিনেমা থিয়েটার বেড়ানো কিছুই নয়। 
গম্ভীর থেকে বলি- মহৎ মানুষরা ওরকমই হয় বোধ হয়। আমি সে তুলনায় কত সামান্য। 
ক্ষণা মাথা নেড়ে বলল- না। তুমি সামান্য নও। যদি তাই হতে তা তোমাকে এত ভালবাসলাম কি করে? তোমার ভেতর একটা কি যেন আছে, ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু সুন্দর কি যেন আছে। তুমি নিজে বোঝ না?
(উপলবাবু বন্ধু সুবিনয়। সুবিনয়ের স্ত্রী ক্ষণা দুই সন্তানের জননী। সুবিনয় প্রীতিকে পাওয়ার জন্য উপলবাবুকে টাকা দেয়, যেন ক্ষণাকে সে নষ্ট করে। ক্ষণা নষ্ট হয়ে সুবিনয়কে ডির্ভোস দিলে সুবিনয় প্রীতিকে বিয়ে করবে। তাই উপলবাবু ক্ষণার সাথে প্রেমের অভিনয় করলেও ক্ষণা সত্যিই উপলবাবুকে ভালোবেসে ফেলে, বিলিয়ে দেয় দেহ-মন)। 

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি- কি করবে ক্ষণা?
-কি আর করব? যত যাই হোক, ওর ঘরই তো আমাকে করতে হবে। শিউরে উঠে বলি তা কেন ক্ষণা? আমি তোমাকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। 
ক্ষণা মাথা নেড়ে বলে- তা কি হয়?
-কেন হবে না?
-আমার ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে যে!
-তাকে কি? নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করবে? সুবিনয়ও দেখো একদিন বড় চাকরি পেয়ে চলে যাবে। আর আসবে না, খোঁজও করবে না। সেদিনের জন্য তৈরী থাকা ভাল ক্ষণা। 
ক্ষণা আমার হাত ধরেই ছিল। সেই ধরা হাতটা একটু শক্ত হয়ে উঠল শুধু।
(গল্পের শেষাংশে প্রীতির কৌশলের কাছে হেরে যায় সুবিনয়। নিজের ভুল বুঝতে পারে। বন্ধু উপল ক্ষণাকে নষ্ট করেছে যেনেও সুবিনয় ক্ষণাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে থাকে। কারণ- সুবিনয়ও প্রীতিকে দিনের পর দিন কোম্পানী থেকে পাওয়া ফ্লাডে নিয়ে নষ্ট করেছিল)

বড় ভাল লোক মানিক সাহা। সে নিজেও সে কথা প্রায়ই বলত- বুঝলে হে উপুল, আমি লোকটা বড় ভাল। লোকে আমারে ভয় দেখায়, বলে, একের অধিক বিবাহ বে-আইনী। একদিন নাকি আমারে জেল খাটতে হবে। কিন্তু আমি কই, জেল খাটাবো খাটাও, কিন্তু আমারে মন্দ কয়ে না কেউ। আমি তা কোনো মেয়ের সঙ্গে নষ্টামী করি নাই। বদমাইশ লোক ঘরে বউ থুয়ে অন্যের সঙ্গে নষ্টামী করে। আমি বদমাইশ না। মেয়েছেলে দেখে মাথা খারাপ হলে আমি তারে বিয়ে করে ফেলি। এইটে সাহজের কাজ, না কি ডুব দিয়ে জল খাওয়াটা সাহসের?
মাসখানেকের মধ্যে তিনটে নৌকে বেচে দিল সে জলের দরে। আটাকল আর দোকানঘর বউদের নামে লিখে দিল। বউরা কেউ মায়াকান্না কাঁদে, কেউ বিকট চেঁচিয়ে গালমন্দ করে মানিক সাহাকে। কিন্তু লোকটা নির্বিকার, কেবল বলে- কাজগুলো স খারাপ হয়েছে। আরো ক’দিন বাদে আমার কাছে গোপনে সে ঝেড়ে কাশল। বললে- তিন বিয়ে ভাল নয়, বুঝলে? অনেক ঝামেলা। তার চেয়ে এক বিয়ে ভাল। 
(মানিক সাহা তার তিন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে, সকল সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে, উপলবাবুকে নিয়ে একটি দ্বীপে পাড়ি জমায়)

মানিক সাহা বিয়ে বসল। বিয়ের ঠিকঠাক হয়ে ছিল আগে থেকেই। গরিবের ঘরের শ্রীময়ী একটা কালো, অল্প বয়সী মেয়ে লাজুক হেসে মানিকের বউ হয়ে গেল। নাম ঝুমুর। মানিক আমাকে চুপিচুপি বলল- এক বিয়ে বুঝলে? এখন থেকে আর বহু বিবাহ নয়। 

(অথচ, ঝুমুর উপলবাবুল প্রেমে পড়ে যায়, তার কাছে বিয়ে বসতে চায়। মানিক সাহাকে সে সহ্য করতে পারে না)

রাত বিরেতে মানকে ভাল করে ঘুমোবার আগেই উঠে আসত। চোখের সামনেই দিন দুপুরে আমাকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে যেত বাগানের দিকে। টের না পাওয়ার কথা নয় মানকের। ভাল করে দেখে শুনে সে অবশেষে একদিন গর্জন করে উঠে বলল- অসতী! অসতী!
যাদের স্বভাব খারাপ তারা টপ করে পায়ে ধরতে পারে। ঝুমুরও পায়ে ধরে কান্নাকাটি করল। প্রথম বলল- ভল দেখেছো। পরে স্বীকার হয়ে বলল- আর হবে না এরকম। 
কিন্তু তাই কি হয়! যা হওয়ার তাই হচ্ছিল ফের। 
এবার মানিক সাহা কেঁদে উঠল এক রাতে। বউয়ের হাত পায়ে ধরে বিস্তর বোঝাল। ঝুমুরও কাঁদল, আদর করে বলল- তোমায় ছুঁয়ে বলছি, আর হবে না। 
আবার হল। 
তৃতীয় দফায় মানিক সাহা একদিন বউকে বেধড়ক ঠেঙাল, তারপর দেড় বেলা বেঁধে রাখল ঘরে। কি জানি কেন এ ব্যাপারে আমাকে তেমন কিছু বলত না মানিক। মাঝে মাঝে কেবল ছানি পড়া চোখের মতো যেন ঠাহর করতে পারছে না, এমনভাবে তাকাত। এক আধবার করুণ স্বরে জিজ্জেস করেছে- উপলভাই, এর চেয়ে কি তিন বিয়েই ভাল ছিল? 
আমি তার কি জানি। চুপ করে থাকতাম। 
সে নিজেই ভেবেচিন্তে বলত- তিনটে বউ থাকলে সুবিধে এই যে, তারা পর পুরুষের কথা ভাববার সময় পায় না, একটাকে নিয়েই কাড়াকাড়ি করে। হিংসুক জাত তো! এক বিয়ে দেখছি বিস্তর ঝামেলা। 
(সত্যিই অসাধারণ এক বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’। আমার জীবনে যদি কোন উপন্যাস একাধিকবার পড়ে থাকি তাহলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’)।      

Friday, September 18, 2020

আন্দামানের সেলুলার জেলখানা
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির মানুষ’

... নাজমুল করিম ফারুক

সবচেয়ে আমাদের কষ্ট হতো কিসের জন্য জানো? আমরা ভেবেছিলাম সকলে আমাদের ভুলে গেছে। দেশ থেকে যত দূরে আমরা আছি, কেউ আমাদের খবর রাখে না। আমরাও কারুর খবর পাই না। পত্রপত্রিকা কিছুই পাই না। আর ব্যাটা চিল এমন হারামজাদা, আমাদের বাড়ি থেকে চিঠিপত্র এলেও দিত না আমাদের। আমরা বুঝেছিলাম, এখানেই তিল তিল করে আমরা মরে যাবো, কেউ আমাদের কথা জানবে না। সেলুলার জেলে কেউ মরলে তার ডেড বডিতে পাথর পায়ে বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। ব্যস, সব শেষ। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির মানুষ’ উপন্যাসের শিবনাথ সেসুলার জেলখানার জীবন যাপনের গল্প বলতে গিয়ে স্বপ্না, মঞ্জুলা, তরুণ, ঝর্ণার সাথে উপরের কথাগুলো বলে ছিলেন।

বিট্রিশ আমলে ভারতীয় বিদ্রোহীদের আন্দামান সেলুলার জেলখানায় কঠিন জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে আনা ‘ছবির মানুষ’ গল্পে মূল চরিত্র বিনায়ক হলেও আমার দৃষ্টিতে জয়ন্তীর বাবা সাধন। আন্দামান জেলখানায় যার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল করুন কষ্টের বোঝা, যা সাধনকে শেষ পর্যন্ত পাগল বানিয়ে দেয়। ধর্ষিতা নারী সরমাকে বিয়ে করে সাধনের মাঝে এক মানুবিক চরিত্র রূপ ফোটে উঠেছে। সত্যকে গোপন রেখে, একজন বিদ্রোহী (কয়েদি) সাতুদাকে নির্মম অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করা চরিত্র সাধনই এই গল্পকে প্রাণবন্ধ করে তুলেছে।

পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সেলুলার জেলখানা রাস্তাটি সাধনের রক্তের বিনিময়ে নির্মিত। যদি তাই না হতো তাহলে সাধনই বা কেন সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে একেবারে বদ্ধ পাগল হয়ে সেলে ফিরে আসবে? এমন দৃশ্য বিনয়কে স্তব্ধ করে দেয়, সত্য প্রকাশে থমকে দাঁড়ায় বিনয়। করুণ পরিণতির মধ্যে দিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে পৌছে যায় সাধন। উপন্যাসটিতে সেলুলার জেলখানা নির্মম অত্যাচারের পরিণত শুধু উঠে আসেনি; উঠে এসেছে জয়ন্তীকে বিনয়ের ভালোলাগার এক অনুভূতি। শুধু মেয়ের বয়সী হওয়ায় জয়ন্তীকে তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। যদিও জয়ন্তী মনজেসের স্ত্রী।    

উপন্যাসটি পড়ে আগ্রহ জাগে, আন্দামান সেলুলার জেলখানা সম্পর্কে জানতে। গুগুলে সার্চ লাইটে গিয়ে জানতে পারলাম- অভিশপ্ত এক দ্বীপের ইতিহাস। যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক ‘কালোপানি’ অধ্যায় রচনা করে রেখেছে।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছেন, লড়াই করেছেন, বিপ্লব করেছেন, তাদেরই অনিবার্য গন্তব্য হয়ে ওঠেছিল আন্দামান সেলুলার জেল। ১৮৯৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯০৬ সালে ৬৯৮টি সেল নিয়ে তৈরি হয় এই জেলটি। কুখ্যাত ইরাকের আবু গারিব জেলের মতোই নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে আছে সেলুলার জেলটি। ১৩ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৬ ফিট প্রস্থ এক একটি কক্ষে বছরের পর বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছে রাজনৈতিক বন্দিদের। খাদ্যের নামে বন্দিদের যা দেওয়া হতো তা ছিল অত্যন্ত নোংরা। ছিল অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। নির্যাতন ছিল প্রাত্যহিক রুটিনের অন্তর্গত। অসংখ্য রাজনৈতিক বন্দি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এসব মহান বন্দির মধ্যে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা থেকে নির্বাসিত বন্দির সংখ্যা বিস্ময়কর রকম বেশি। এক হিসেবে দেখা গেছে জেলটিতে ১৯৩৭ সালে মোট বন্দি ছিলেন ৩৮৫ জন। এর মধ্যে বাংলার বন্দির সংখ্যা ছিল ৩৩৯ জন। বাকি বন্দিরা বিহারের ১৯, উত্তর প্রদেশের ১১, আসামের ৫, পাঞ্জাবের ৩, দিল্লির ২ এবং মাদ্রাজের  ২জন।

আন্দামান ১৮৪টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ১৭৮৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব মিস্টার ব্লেয়ার আন্দামানে অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তখন দ্বীপজুড়ে বসবাস করতেন বেশ কিছু আদিবাসী মানুষ। একপর্যায়ে সাহেবরা প্রতিকূল আবহাওয়ায় নাকানিচুবানি খেয়ে দ্বীপ ছেড়ে চলে আসেন। তবে জরুরি প্রয়োজনে ইংরেজরা ১৮৫৮ সালের জানুয়ারির দিকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতবর্ষের বিদ্রোহী মানুষকে এই দ্বীপে এনে বন্দি করে রাখলে বেশ হয়। কারণ জঙ্গলে প্রচুর ভয়ংকর প্রাণী আছে। আর পাহারার কাজে থাকবে প্রচুর ভয়ংকর ইংরেজ ও তাদের পোষ্য। এরই মধ্যে তথাকথিত ‘সিপাহি বিপ্লব’ ওরফে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলো। সিপাহিরা ও শেষ নবাব বাহাদুর শাহ পরাজিত হলেন। ইংরেজরা ভয়াবহ প্রতিশোধ নিতে লাগলেন। হাজার হাজার সিপাহি ও দিল্লির অধিবাসীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। দিল্লির প্রায় প্রতিটি গাছের ঢালেই তখন ঝুলেছিল বিদ্রোহীদের লাশ। এত ঝোলানোর পরও প্রচুর মানুষ বাদ থেকে যায়। ক্ষান্ত ইংরেজ প্রশাসন বুদ্ধি বের করল। তারা আবিষ্কার করল পুনরায় আন্দামানকে। শুরু হলো জেল গড়ার কাজ।

১০ মার্চ ১৮৫৮। জে.বি ওয়াকারের নেতৃত্বে ২০০জন বিদ্রোহীকে নিয়ে প্রথম জাহাজ ভিড়লো আন্দামানে। দ্বিতীয় ব্যাচ বন্দি-বিদ্রোহী আসেন করাচি থেকে ১৮৬৮ সালে। তাদের সংখ্যা ছিল ৭৩৩। তারা সবাই ছিলেন যাবজ্জীবন দন্ড প্রাপ্ত। এরপর আর হিসাব-নিকাশ নাই। হাজার হাজার বিদ্রোহী মানুষ যারা ইংরেজ রাজত্ব চাননি ভারতবর্ষে, তারা আসতে লাগলেন আন্দামানে ইংরেজদের হাতে আক্ষরিক অর্থেই শৃঙ্খলিত হয়ে, দন্ড প্রাপ্ত হয়ে। 

মার্চ ১৮৬৮। ২৩৮ জন কয়েদি চেষ্টা করলেন পালাতে। কিন্তু এপ্রিল মাসের মধ্যেই সবাই আবার ধরা পড়লেন ইংরেজদের হাতে। জেলার ওয়াকারের আদেশে ৮৭ জনকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় পালানো চেষ্টার অভিযোগে। তারপরও প্রতিরোধ চেষ্টা থেমে থাকেনি। ওহাবি আন্দোলনের সূত্রে আন্দামান এসেছিলেন শের আলী যাবজ্জীবন 
দন্ড মাথায় নিয়ে। লর্ড মেয়কে বাগে পেয়ে শের আলী সোজা চাকু বসিয়ে দিলেন তার বুকে। লর্ড নিহত হলেন বন্দি শের আলীর হাতে। এ ছিল প্রতীকী খুন। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৭২-এ কাইপার আইল্যান্ডে শের আলীকে ফাঁসি দেওয়া হয়। মোটকথা, তখনকার আন্দামান ছিল বন্দিদের সামনে নরকেরই জাগতিক সংস্করণ।

লেখক পরিচিতি :
নাজমুল করিম ফারুক
সভাপতি : তিতাস উপজেলা প্রেসক্লাব
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা।

Wednesday, January 4, 2017

বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট উদ্যান ও বড় দিঘি
দিনাজপুরের রামসাগর

বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জাতীয় উদ্যান এবং সবচেয়ে বড় দিঘি রামসাগরই হচ্ছে দিনাজপুরের রামসাগর জাতীয় উদ্যান। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে অবস্থিত এ জাতীয় উদ্যানটি। উদ্যানটি ঘুরে এসে সেই কাহিনী জানাচ্ছেন দৈনিক রূপসী বাংলা পত্রিকার তিতাস প্রতিনিধি নাজমুল করিম ফারুক

১৭৫০-৫৫ সালের কথা। এই সময়ে এ অঞ্চলে প্রচণ্ড খরা আর দুর্ভি চলছিল। রাজা রামনাথ প্রজাদের সেচ সুবিধা, জনকষ্ট দূরীকরণ আর খাদ্যাভাব পূরণের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে তখনকার প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয়ে এ দিঘি খনন করেন এবং নিজের নামেই এর নামকরণ করেন। তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, রামসাগর জাতীয় উদ্যানের আয়তন প্রায় ২৭ হেক্টর। যার মধ্যে মূল দিঘির দৈর্ঘ্য ১০৩১ মিটার আর প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। রামসাগর দিঘি উত্তর-দেিণ লম্বা আকৃতির। দিঘিটির উত্তরের দিকটি অপোকৃত বেশি গভীর। বেশ কয়েকটি পাকা ঘাট থাকলেও প্রধান ঘাটটি পশ্চিম পাড়ের ঠিক মাঝ বরাবর। প্রায় ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬০ ফুট প্রস্থ এ ঘাটটি। দিঘির উত্তর, দণি ও পূর্বপাশেও একটি করে ছোট ঘাট রয়েছে। দিঘিটির চারপাশে গাছে গাছে ঢাকা ইট বাঁধানো পথ আর ছোট ছোট কয়েকটি টিলা। রামসাগর দিঘির পশ্চিম পাশে ছোট একটি চিড়িয়াখানা আছে। চিড়িয়াখানায় কিছু কিছু প্রাণির অস্তিত্ব থাকলেও আগত দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে কৃত্রিম বিভিন্ন জীব জন্তুর প্রতিকৃতি। এখানে বেড়াতে আসলে নানা রকম গাছপালা পাশাপাশি এ উদ্যানে দেখা মেলবে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এখানে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে।

১৯৬০ সালে রামসাগর দিঘিটি বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে আসে। ১৯৯৫-৯৬ সালে সরকার এটিকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন এবং ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল রামসাগর এলাকাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে রামসাগর জাতীয় উদ্যান। নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে এখানে প্রবেশ করা যায়। নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে গাড়ী নিয়েও এখানে ঘুরে আসতে পারেন। নিজস্ব পরিবহন না থাকলে দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১৫০-২০০ টাকায় ব্যাটারী চালিত রিক্সায় রামসাগর পৌছতে পারবেন। সময় লাগবে প্রায় ৩০ মিনিট।


কীভাবে যাবেন ঃ ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী বাসগুলো সাধারণত ছাড়ে গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে। এসি- নন এসি বাস পাওয়া যায়। এসির ভাড়া ৯০০-১০০০ টাকা হলেও নন এসি বাসে ভাড়া পড়বে ৫০০-৬০০ টাকা। নাবিল, হানিফ, এসআর, কেয়া, এসএ, শ্যামলী পরিবহনের যাতায়াত করা যায়। তবে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর ট্রেন দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও একতা এক্সপ্রেস দিয়েও যেতে পারবেন এবং ঢাকায় ফিরতে পারবেন। তবে এ দুটি সার্ভিস সপ্তাহে ২ দিন করে বন্ধ থাকে।    

কোথায় থাকবেন ঃ রামসাগরে বনবিভাগের একটি বিশ্রামাগার থাকলেও সাধারণ পর্যটকদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা নেই। রামসাগর ভ্রমণে গেলে তাই থাকতে হবে দিনাজপুর শহরে। দিনাজপুর শহরে থাকার জন্য ভালো মানের হোটেল হচ্ছে পর্যটন মোটেল। এছাড়াও শহরের মালদহ পট্টিতে হোটেল ডায়মন্ড, নিমতলায় হোটেল আল রশিদ, হোটেল নবীন, হোটেল রেহানা ও নিউ হোটেলে থাকতে পারেন।