Friday, September 18, 2020

আন্দামানের সেলুলার জেলখানা
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির মানুষ’

... নাজমুল করিম ফারুক

সবচেয়ে আমাদের কষ্ট হতো কিসের জন্য জানো? আমরা ভেবেছিলাম সকলে আমাদের ভুলে গেছে। দেশ থেকে যত দূরে আমরা আছি, কেউ আমাদের খবর রাখে না। আমরাও কারুর খবর পাই না। পত্রপত্রিকা কিছুই পাই না। আর ব্যাটা চিল এমন হারামজাদা, আমাদের বাড়ি থেকে চিঠিপত্র এলেও দিত না আমাদের। আমরা বুঝেছিলাম, এখানেই তিল তিল করে আমরা মরে যাবো, কেউ আমাদের কথা জানবে না। সেলুলার জেলে কেউ মরলে তার ডেড বডিতে পাথর পায়ে বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। ব্যস, সব শেষ। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির মানুষ’ উপন্যাসের শিবনাথ সেসুলার জেলখানার জীবন যাপনের গল্প বলতে গিয়ে স্বপ্না, মঞ্জুলা, তরুণ, ঝর্ণার সাথে উপরের কথাগুলো বলে ছিলেন।

বিট্রিশ আমলে ভারতীয় বিদ্রোহীদের আন্দামান সেলুলার জেলখানায় কঠিন জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে আনা ‘ছবির মানুষ’ গল্পে মূল চরিত্র বিনায়ক হলেও আমার দৃষ্টিতে জয়ন্তীর বাবা সাধন। আন্দামান জেলখানায় যার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল করুন কষ্টের বোঝা, যা সাধনকে শেষ পর্যন্ত পাগল বানিয়ে দেয়। ধর্ষিতা নারী সরমাকে বিয়ে করে সাধনের মাঝে এক মানুবিক চরিত্র রূপ ফোটে উঠেছে। সত্যকে গোপন রেখে, একজন বিদ্রোহী (কয়েদি) সাতুদাকে নির্মম অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করা চরিত্র সাধনই এই গল্পকে প্রাণবন্ধ করে তুলেছে।

পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সেলুলার জেলখানা রাস্তাটি সাধনের রক্তের বিনিময়ে নির্মিত। যদি তাই না হতো তাহলে সাধনই বা কেন সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে একেবারে বদ্ধ পাগল হয়ে সেলে ফিরে আসবে? এমন দৃশ্য বিনয়কে স্তব্ধ করে দেয়, সত্য প্রকাশে থমকে দাঁড়ায় বিনয়। করুণ পরিণতির মধ্যে দিয়ে জীবনের শেষপ্রান্তে পৌছে যায় সাধন। উপন্যাসটিতে সেলুলার জেলখানা নির্মম অত্যাচারের পরিণত শুধু উঠে আসেনি; উঠে এসেছে জয়ন্তীকে বিনয়ের ভালোলাগার এক অনুভূতি। শুধু মেয়ের বয়সী হওয়ায় জয়ন্তীকে তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। যদিও জয়ন্তী মনজেসের স্ত্রী।    

উপন্যাসটি পড়ে আগ্রহ জাগে, আন্দামান সেলুলার জেলখানা সম্পর্কে জানতে। গুগুলে সার্চ লাইটে গিয়ে জানতে পারলাম- অভিশপ্ত এক দ্বীপের ইতিহাস। যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক ‘কালোপানি’ অধ্যায় রচনা করে রেখেছে।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছেন, লড়াই করেছেন, বিপ্লব করেছেন, তাদেরই অনিবার্য গন্তব্য হয়ে ওঠেছিল আন্দামান সেলুলার জেল। ১৮৯৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯০৬ সালে ৬৯৮টি সেল নিয়ে তৈরি হয় এই জেলটি। কুখ্যাত ইরাকের আবু গারিব জেলের মতোই নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে আছে সেলুলার জেলটি। ১৩ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৬ ফিট প্রস্থ এক একটি কক্ষে বছরের পর বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছে রাজনৈতিক বন্দিদের। খাদ্যের নামে বন্দিদের যা দেওয়া হতো তা ছিল অত্যন্ত নোংরা। ছিল অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। নির্যাতন ছিল প্রাত্যহিক রুটিনের অন্তর্গত। অসংখ্য রাজনৈতিক বন্দি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এসব মহান বন্দির মধ্যে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা থেকে নির্বাসিত বন্দির সংখ্যা বিস্ময়কর রকম বেশি। এক হিসেবে দেখা গেছে জেলটিতে ১৯৩৭ সালে মোট বন্দি ছিলেন ৩৮৫ জন। এর মধ্যে বাংলার বন্দির সংখ্যা ছিল ৩৩৯ জন। বাকি বন্দিরা বিহারের ১৯, উত্তর প্রদেশের ১১, আসামের ৫, পাঞ্জাবের ৩, দিল্লির ২ এবং মাদ্রাজের  ২জন।

আন্দামান ১৮৪টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ১৭৮৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব মিস্টার ব্লেয়ার আন্দামানে অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তখন দ্বীপজুড়ে বসবাস করতেন বেশ কিছু আদিবাসী মানুষ। একপর্যায়ে সাহেবরা প্রতিকূল আবহাওয়ায় নাকানিচুবানি খেয়ে দ্বীপ ছেড়ে চলে আসেন। তবে জরুরি প্রয়োজনে ইংরেজরা ১৮৫৮ সালের জানুয়ারির দিকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতবর্ষের বিদ্রোহী মানুষকে এই দ্বীপে এনে বন্দি করে রাখলে বেশ হয়। কারণ জঙ্গলে প্রচুর ভয়ংকর প্রাণী আছে। আর পাহারার কাজে থাকবে প্রচুর ভয়ংকর ইংরেজ ও তাদের পোষ্য। এরই মধ্যে তথাকথিত ‘সিপাহি বিপ্লব’ ওরফে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলো। সিপাহিরা ও শেষ নবাব বাহাদুর শাহ পরাজিত হলেন। ইংরেজরা ভয়াবহ প্রতিশোধ নিতে লাগলেন। হাজার হাজার সিপাহি ও দিল্লির অধিবাসীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। দিল্লির প্রায় প্রতিটি গাছের ঢালেই তখন ঝুলেছিল বিদ্রোহীদের লাশ। এত ঝোলানোর পরও প্রচুর মানুষ বাদ থেকে যায়। ক্ষান্ত ইংরেজ প্রশাসন বুদ্ধি বের করল। তারা আবিষ্কার করল পুনরায় আন্দামানকে। শুরু হলো জেল গড়ার কাজ।

১০ মার্চ ১৮৫৮। জে.বি ওয়াকারের নেতৃত্বে ২০০জন বিদ্রোহীকে নিয়ে প্রথম জাহাজ ভিড়লো আন্দামানে। দ্বিতীয় ব্যাচ বন্দি-বিদ্রোহী আসেন করাচি থেকে ১৮৬৮ সালে। তাদের সংখ্যা ছিল ৭৩৩। তারা সবাই ছিলেন যাবজ্জীবন দন্ড প্রাপ্ত। এরপর আর হিসাব-নিকাশ নাই। হাজার হাজার বিদ্রোহী মানুষ যারা ইংরেজ রাজত্ব চাননি ভারতবর্ষে, তারা আসতে লাগলেন আন্দামানে ইংরেজদের হাতে আক্ষরিক অর্থেই শৃঙ্খলিত হয়ে, দন্ড প্রাপ্ত হয়ে। 

মার্চ ১৮৬৮। ২৩৮ জন কয়েদি চেষ্টা করলেন পালাতে। কিন্তু এপ্রিল মাসের মধ্যেই সবাই আবার ধরা পড়লেন ইংরেজদের হাতে। জেলার ওয়াকারের আদেশে ৮৭ জনকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় পালানো চেষ্টার অভিযোগে। তারপরও প্রতিরোধ চেষ্টা থেমে থাকেনি। ওহাবি আন্দোলনের সূত্রে আন্দামান এসেছিলেন শের আলী যাবজ্জীবন 
দন্ড মাথায় নিয়ে। লর্ড মেয়কে বাগে পেয়ে শের আলী সোজা চাকু বসিয়ে দিলেন তার বুকে। লর্ড নিহত হলেন বন্দি শের আলীর হাতে। এ ছিল প্রতীকী খুন। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৭২-এ কাইপার আইল্যান্ডে শের আলীকে ফাঁসি দেওয়া হয়। মোটকথা, তখনকার আন্দামান ছিল বন্দিদের সামনে নরকেরই জাগতিক সংস্করণ।

লেখক পরিচিতি :
নাজমুল করিম ফারুক
সভাপতি : তিতাস উপজেলা প্রেসক্লাব
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা।

No comments:

Post a Comment