Saturday, September 17, 2016

সাত পাহাড়ের মুখখ্যাত জল পাহাড় পাথরের বিছানাকান্দি

নাজমুল করিম ফারুক
পাথর, পানি, পাহাড় আর আকাশ নিয়েই যেন বিছানাকান্দি। এখানে আসার পর যে কথাটি সর্বপ্রথম মনে হয় তা হল প্রশান্তি। এই প্রশান্তিটুকু নিমিষেই ভুলিয়ে দেয় প্রতিদিনকার শত গ্লানি। বিছানাকান্দির প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে যেন হার মানতেই হয় নাগরীক সভ্যতাকে। আর এই চরম সত্যটুকু উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে চলে আসতে হবে বিছানাকান্দিতে। 
মায়াবী অপূরুপা স্বচ্ছজল আর পাথরের বিছানাকান্দি।
বিছানাকান্দির আরেক নাম সাত পাহাড়ের মুখ। কারণ এখানে দাঁড়িয়ে একসাথে দেখা যায় মেঘালয় রাজ্যের সাতটি পাহাড়ের মুখ। স্বচ্ছ জলধারা পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট বড় পাথর ডিঙ্গিয়ে এসে পড়ে পিয়াইন নদীতে। বাংলাদেশের শত কর্ম ব্যস্ততা, আকাশ, নদী, ঘর-বাড়ি আর ফসলী জমিকে পেছনে ফেলে আপনি যতটা না এগিয়ে যাবেন শেষ সীমান্তের দর্শনে ততটা এগিয়ে আসবে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের হাতছানি। শিল্পীর তুলির মতো আঁকা পাহাড়গুলো থেকে বেয়ে পড়া স্বচ্ছ পানির ঝরনা আপনাকে মুগ্ধ করবে আর দু'চোখের মাঝে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে পাশাপাশি অবস্থান করা সাতটি পাহাড়।
দেশের সীমানার গন্ডি পেরিয়ে দূরে আকাশের গায়ে সাতপাহাড়ের মুখ।
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত সীমান্ত এলাকা রোস্তমপুরই বিছানাকান্দি। হাদারপাড় বাজার থেকে বর্ষা মৌসুমে নৌকা আর শুষ্ক মৌসুমে হেঁটে যেতে হয় বিছানাকান্দি। দেশের যেকোন স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে আসবে হবে সিলেট শহরে। তারপর আম্বরখানা থেকে সিএনজি/মাইক্রো ভাড়া করে বিমানবন্দরের রাস্তা ধরে হাদারপাড় হাইস্কুলের মোড় হয়ে হাদারপাড় বাজারে আসতে হয়। এটিই সিলেট থেকে বিছানাকান্দি আসার মূল সড়ক। বর্তমানে এ রাস্তাটির অবস্থা এতই নাজুক যে বলে শেষ করা যাবে না। তবে সিলেট-জাফলং সড়ক দিয়েও বিছানাকান্দি যাওয়া যায়। এ রাস্তাটি চলাচলের উপযোগী ও আরামদায়ক। এেেত্র আপনাকে গোয়ানঘাট বাইপাস নতুন বাস স্টেশন হয়ে হাদারপাড় হাইস্কুলের মোড় অতঃপর হাদারপাড় বাজার। হাদারপাড় বাজার থেকে বর্ষা মৌসুমে ট্রলার দিয়ে পিয়াইন নদী হয়ে আপনাকে বিছনাকান্দি পৌছতে হবে আর শুষ্ক মৌসুমে ট্রলারের পরিবর্তে মোটরসাইকেল এবং পা একমাত্র সম্ভল।      
স্বচ্ছ পানি আমাকে করেছে মুগ্ধ গা না ভিজালে দেহ হবে না শান্ত।
  তবে নৌকা করে বিছানাকান্দি আসার পুরো পথটা অসম্ভব রোমাঞ্চকর। স্বচ্ছ আর ঠাণ্ডা পানি ঠেলে নৌকার এঁকেবেঁকে বয়ে চলা মনে এনে দেয় অদ্ভুত প্রশান্তি। তার উপর বাড়তি পাওনা হিসেবে তো আছে আশেপাশের গগনচুম্বী পাহাড় আর মাথার উপর শুভ্র শান্ত আকাশের আবরণ। পথ যত কমতে থাকে অস্পষ্ট পাহাড়গুলো স্পষ্ট নিরেট আকার নিতে থাকে আর তখন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। যেন কোন শিল্পীর আঁকা ছবির মত এ দৃশ্য, প্রতিটি খাঁজে রয়েছে অপার সৌন্দর্য আর নিখুঁত কারুকার্যের নিদর্শন। যাওয়া বা আসার পথে পিয়াইন নদীতে দেখা মিলবে পাথর উত্তোলনকারীদের। নদী থেকে পাথর উত্তোলন, নৌকা করে গন্তব্যে পৌছা এক বাড়তি অভিজ্ঞতা। এমনি করে চলতে চলতে কখন যে পথ শেষ হয়ে আসে তা বলা মুশকিল। কিন্তু পথ শেষ হলে হবে কি সৌন্দর্যের শেষ হবার উপায় নেই। কারন তখন আপনি চলে এসেছেন অপরূপা বিছানাকান্দিতে।
বিছানাকান্দি যাওয়ার পথে দেখা মেলবে পিয়াইন নদীতে পাথর বোঝাই নৌকা।
পা ফেলার সাথে সাথে এই ভাবনাটুকু কখন যে তলিয়ে যাবে বুঝতেই পারবেন না। পা রাখতেই টের পাওয়া যাবে কেন বিছানাকান্দিতে আসা। স্বচ্ছ আর হিমশীতল পানির নিচে যেন শত শত পাথরের মেলা বসেছে। নানা রঙের, নানা আকারের আর বিচিত্র সব পাথরে ভরপুর এই জায়গাটিকে পাথরের রাজ্য বললে ভুল হবে না। শুধু পা ভিজিয়ে ান্ত থাকেন না এখানে আসা মানুষগুলো। শরীর এলিয়ে দিয়ে যখন চোখ বুজে আসে তখন একে পাথর বিছানো বিছনাই মনে হবে। বর্ষার সময়টাতে পানিতে টইটুম্বুর থাকে বিছানাকান্দি আর তখন একে তুলনা করা যায় সবে কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দেওয়া তরুনীর সাথে। অপরূপ চোখ জুড়ানো এক মোহনীয়তায় যেন আবিষ্ট করে রাখে এখানে আসা মানুষগুলোকে। তাই সময় করে ঘুরে আসতে পারেন স্বচছ জল আর পাথর পাহাড়ের বিছানাকান্দি। 
হাদারপাড় বাজারে অপেমান নৌযান যা আপনাকে নিয়ে যাবে বিছানাকান্দি।
সাবধানতা :
মেঘালয়ের পাহার থেকে বেয়ে আসা স্বচ্ছ পানির জলধারা আপনাকে কাছে টেনে নেবে তবে এখানে কোন সীমানা প্রাচীর না থাকায় আপনাকে বাংলাদেশের সীমানার মধ্য থেকেই সবকিছু উপভোগ করতে হবে। তবে হাটের দিন যদি আপনার ভ্রমণ হয় তাহলে খুব সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে এবং অবৈধ পণ্যবহন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। 
বিছানাকান্দিতে ‘আমরা ঘুরি সারা বাংলাদেশ’ গ্র“পের সদস্যবৃন্দ। 
লেখক-
নাজমুল করিম ফারুক
সাধারণ সম্পাদক
তিতাস উপজেলা প্রেসকাব,
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা।

Friday, August 5, 2016

বন্ধু কেমন আছো; আজও ভুলতে পারিনি তোমায়

খোলা চিঠি

৭ আগষ্ট’২০১৬ আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস। সময়ের আবর্তনে কালে কালে এদিবসটি ফিরে আসে বারবার। কিন্তু যাকে ঘিরে আমার বন্ধুত্বের স্বপ্ন বুনা সেই মনের মানুষের কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা স্মৃতিমাখা মুখখানি কি ভুলা যায়? তাইতো এমন দিনে মনে পড়ে তার কথা; চোখের সামনে ভেসে উঠে কোমল হাতের ভালোবাসার নিষ্পাপ স্পর্শের আলতো ছোঁয়া। সত্যিই আজও তোমাকে ভুলতে পারিনি, খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছো নিগার? 
                                              ২০০৫ সালের ৩ আগষ্ট দৈনিক প্রথম আলো’তে ছাপা একটি ফিচার
নিগার,
শিশির ভেজা সিগ্ধ সকালের মায়াবী কুয়াশার পরশ রাঙিয়ে পূর্ব আকাশে অনেক স্বপ্নের ফুলঝুঁড়ি নিয়ে পৃথিবীর আকাশে উদয় হয় সূর্য কিরণের। কিন্তু শুধু উদয় হও না আমার মনের আকাশে তুমি। মেঘের কালো বিমূখে নিজেকে আড়াল করে রাখলে নিজের মতো অভিনয় করে। সূর্যের মতো নিজ থেকেই উঁকি দিলে আমার জরাজীর্ণ পৃথিবীতে। আমি বাঁধা দেয়নি, তাইতো ভালোবাসার আভা ছড়ালে সূর্যের মতো। উজ্জ্বল হলো আমার চারপাশ, আলোকিত হলো হৃদয়।  
তোমাকে নিয়ে আপন খেয়ালে ডুবে থাকতে খুব ভালো লাগে। সুযোগ পেলে তাই ভাবনার অতলে ডুব দেই। তখন নিজেকে রাখি ঘরকুনো করে। আবার কখনও কখনও মন হয়ে যায় পারাবতের মতো। মনে হয়, ডানা মেলে নীল আকাশ স্পর্শ করি, ছুটে যাই তোমার মাঝে। কিন্তু ভাবনাগুলো খুব বেশি ডালপালা মেলার সুযোগ পায় না। নিজেকে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা জগত সংসারে ফিরে আসতে হয়। তারপরও একাতিত্বের কাছে বারবার হেরে যাই। যে একাতিত্বকে আমি কুঁড়িয়ে নিয়ে ছিলাম অসম জীবনের বাঁকে। পৃথিবীর একপ্রান্তে যখন আজ আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি তখনই মনে হচ্ছে এটাই ছিল আমার প্রথম ভুল। ভুল মানুষের সংসারে ভুল মানুষ হয়েই রইলাম। দেখলো না কেউ, জানলো না কেউ, নীরবে কেঁদে গেলাম।
কান্নাই তো আমার ঘর-সংসার, দুঃখ আমার সাজনো বাগান, কষ্ট আমার পরিপাটি, চোখের জল দেহের অলংকার, কাউকে বুঝতে দেয়নি। গম্ভীরতা আর নীরবতা ছিল আমার নিত্য সঙ্গী। প্রথম বেলাতে হৃদয়ে যাকে ঠাঁই দিয়েছিলাম চার বেহারার পালকী করে তাকে তো বাড়ীর পাশের কবরস্থানে লুকিয়ে রেখেছি। বারবার চেষ্টা করেছি, তাকে বুঝাতে ‘আমি তোকে ভালোবাসি, শুধু তোকে ভালোবাসি’। আমার চাওয়া-পাওয়ার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সে নিজেই সলিল সমাধি হয়ে গেল, নিজের মতো করে। আমি আটকাতে পারেনি বলে; যেতে বাঁধাও দেয়নি। শুধু পেছন থেকে তাঁকিয়ে দেখেছি নীরবে তার চলে যাওয়া। সেই হেঁটে যাওয়া রাস্তায় আজ চোখ পড়লে হৃদয় গভীরে আচমকা কষ্টের ঢোল বাঁজে। এটাই ভালো ছিল, কেন তুমি উদয় হলে আমার জীবনে? এ প্রশ্নটা প্রশ্নই থেকে গেল।
নিগার,
নিজ থেকে আসলে নিজ থেকে চলে গেলে। কোথায় ছিল আমার ভুল। তোমার ইচ্ছায় শতশত মাইল আমি পাড়ি দিয়েছি, কান্ত হয়নি। রাতের গভীরে অজানা শহরে নিজেকে উৎসর্গ করেছি, ভয় পাইনি। আমি তোমার আঙ্গিনায় আসতে রাত ১টা বেঁজে গেছে, তুমি কেন ঘুমাওনি? জবাবে বলে ছিলে, তুমি কুমিল্লা থেকে ময়মনসিংহে আসবে আর আমি ঘুমিয়ে থাকবো, আগে হোটেলে উঠো, তারপর আমি ঘুমাবো। সেই দিন বন্ধুত্বের যে মহান উদাহরণ তুমি আমার সামনে মেলে দিলে, আমিও বুঝে নিলাম এরই নাম বন্ধু ও বন্ধুতা।
যতবার তোমার আঙ্গিনায় আমি পা রেখেছি, ততবার নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। একটা ছাতার নীচেই তো আমাদের ঠাঁই হয়েছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে নিজেকে ভিজালেও আমাকে ভিজতে দেওনি। ব্রহ্মপুত্র নদের হিমেল ঠান্ডা হাওয়া তোমার লম্বা চুলের খোঁপা বাঁধা ‘বেনী’ না উড়লেও মুখের চারদিকে ছোট ছোট চুলগুলো আলপনা এঁকে ছিল, আমি শুধু তাকিয়ে দেখেছি। আর মনের গভীরে তার ছবি এঁকেছি। বৃষ্টিভেজা ঘাসের উপর গোলপাতার পাটি ছড়িয়ে পাশাপাশি বসে বলেছিলাম, জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে বয়ে যাওয়া নিষ্ঠুর স্রোতের কথা, বলেছিলাম সাতরাতে সাতরাতে আমার দেহের মেরুদন্ডটা বাঁকা হয়ে গেছে। এটা আর সোঁজা করতে চাই না। যদি আবার ভেঙ্গে যায়। জবাবে, তুমি বলেছিলে, আমি আছি; থাকবো। এখান থেকে নতুন করে শুরু করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এই জানো, ঐসব কথা আজ আমার রুমের আলমারিতে সাঁজিয়ে রাখা আসবাবপত্র। মাঝে মাঝে রংধনুর মতো পূর্বাকাশে উকি মেরে কালো মেঘের আড়ালে পালিয়ে যায়। ২০দিনের স্থলে ১৭দিন ছুটি কাটিয়ে এসে বলেছিলে, ১৭ বছর পার করে এসেছি, তোমার সাথে কথা না বলে একরাতও ঘুমাতে পারিনি। আবার তুমিই বললে, আমাকে ভুলে যাও, আমি আর পারছিনা। বিউটি পালারের রুপচর্চার আড়ালে নিজেকে নিয়ে গেলে মুহুর্তের মধ্যে। প্রশ্ন করে ছিলাম, আমি তো নিঃশেষ হওয়া একটা বস্তু এটা কি আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে, বায়না ধরেছিলে, ‘তোমাকে পারতে হবে’, পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি পারবে, জবাবে বলেছিলে, ‘মেয়েরা অনেক কিছু পারে; তাদের অনেক কিছু পারতে হয়’। 
যে ভালোবাসার আবরণে তুমি আমাকে ঢেকেছিলে; আমি তাকে হারাতে চাইনি বলে, তুমি যা চেয়েছো তাই করেছি। নিজেই অন্যের হাতে আমাকে তুলে দিলে, ঘর-সংসার সাজানোর জন্য বললে, আমাকে দূরে থাকতে বললে। যথারীতি নিরবতা পালন করেছি, শুধু তোমাকে ভালোবাসি বলে। হারাতে চাইনি বলে দু’হাত জোড় করে বলেছিলাম, শুধু বন্ধুতা থাকুক, শুধু বন্ধুত্ব।
আমি বিশ্বাস করি, বন্ধু মানে একটি মানুষের পরিবর্তনের চাবিকাঠি। এরিস্টটল বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের নাম নাকি বন্ধুত্ব। আমি বিশ্বাস করি বন্ধুত্ব মানে আত্মার আত্মীয়, পরস্পরের মাঝে সহযোগিতা, বন্ধুত্ব মানে বিপদে পাশে থাকা, সুখে দুঃখে এক হওয়া। জীবনের নির্দিষ্ট কোনো বাঁকে নয়, বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি সারাজীবনের সর্বণের। বন্ধুত্বকে পরিমাপ করা যায় না, করার দরকারও হয় না। কারণ বন্ধুত্ব হচ্ছে আঁধার রাতে প্রদীপ জ্বালানো আলো। শুধু নিজের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-কে নিজের দেহ-মন-অন্তর থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম বন্ধুতা। দু’হাত জোর করে বলেছিলাম, আর কোনদিন এ হৃদয়ে ভালোবাসার জন্ম দেব না; শুধু তোমার সাথে বন্ধুত্ব থাকুক। তুমি একাত্মচিত্রে গ্রহণ করে নিলে। শত কষ্টের মাঝে এক পশলা চোখের পানির মাঝে রংধনুর আবিরভাব হলো। নিজেকে ঘুটিয়ে নিলাম। শুধু বন্ধুত্বা আর বন্ধুত্বে।
কিভাবে নাটক সাজালে তার নাট্যকার তো তুমিই। আমি আর কি বলবো। বছরের পর বছর তোমার মোবাইল ফোন যখন বাঁজতে থাকে, তখন আমাকে একটি প্রশ্নই স্তব্ধ করে দেয়। ‘মেয়েরা সব পারে; তাদের অনেক কিছু পারতে হয়’।    
তারপরও প্রশ্নজাগে- আর কতকাল খোঁজবো তোমায়?

ইতি
চেনার মাঝে অচেনা অতিথি 
নাজমুল করিম ফারুক

Wednesday, July 27, 2016

কুমিল্লা দর্শন

কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নাজমুল করিম ফারুক

কুমিল্লা জেলাসহ এ অঞ্চলের ভূ-ভাগের ভিত্তিমূল স্থাপিত হয় আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি বছর আগে মায়োসীনে যুগে। সূচনা থেকে অদ্যবধি প্রায় ৪০ হাজার ফিট আস্তরনের ভিত্তিমূলে ও স্তুপী মূলে স্তূপীকৃত হয়েছে। প্রাচীনকালের মানচিত্রে দেখা যায় লোহিত (বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র) নদীর অববাহিকায় প্রাগজ্যোতিষ ও পূর্ব ভাগে পাহাড়ের পাদদেশের অঞ্চল কিরাতস নামে অভিহিত ছিল। ধারনা করা হয় এই কিরাতাসের অধিকাংশ স্থান নিয়েই গঠিত হয় সমতট অঞ্চল, পরবর্তীতে ভারত বর্ষের ত্রিপুরা, ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লা।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানী অধিকার করার পর ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দ সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা) পরগনা ব্যতীত বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার পুরো এলাকা নিয়ে একটি জেলা গঠন করা হয়। যার নামকরণ করা হয় ত্রিপুরা জেলা। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালী ও ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালীর ছাগলনাইয়ার অংশ ত্রিপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ১ অক্টোরব এক প্রশাসনিক আদেশে কুমিল্লা জেলা নামে জেলার নাম অভিহিত হয়। 
 ত্রিপুরা রাজ্যের তিচ্না উর্ধ্বভাজ থেকে উৎপন্ন হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লা শহরের ৮ মাইল পূর্বে অবস্থিত বিবির বাজারের কাছে জেলায় প্রবেশ করেছে গোমতী নদী। কুমিল্লা শহরকে ছেড়ে  গোমতী নদী জাফরগঞ্জ, দেবিদ্বার, কোম্পানীগঞ্জ ও মুরাদনগর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে উত্তর-পশ্চিম দিকে। এরপর মুরাদনগর থেকে দণি-পশ্চিমে তিতাস উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দাউদকান্দির কাছে মেঘনার শাখা কলাতিয়া'তে মিশেছে। মেঘনার কলাতিয়া শাখায় গোমতী যেখানে মিশেছে, সেই মিলিত স্রোতও গোমতী নামে পরিচিত। দাউদকান্দির মাইলখানেক দক্সিণ পশ্চিমে বাঁক নিয়ে ধনাগোনা নামে শাখা সৃষ্টি করেছে। এই ধনাগোদা মতলবের পশ্চিম অংশও গোমতী নামে পরিচিত। নদী শাসনের পূর্বে গোমতী ছিল প্রশস্ত। ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে মোঘলদের নৌ-বাহিনী গোমতী বেয়ে ত্রিপুরার তৎকালীন রাজধানী উদয়পুর আক্রমন করেন। আর সেই গোমতীর তীরেই কুমিল্লা শহরটি অবস্থিত।
কুমিল্লা জেলার নামকরণ নিয়ে নানামতের মধ্যে একটি হলো- আজ থেকে ১৩৬৬ বছর (৬৩৭খ্রিঃ) আগে ভুবনশ্র“ত চৈনিক বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষে এসেছেন। উদ্দেশ্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহাস্থবির শীলভদ্রের কাছে শিা গ্রহণ। সেই আচার্য শীলভদ্র’র বাড়ি “কিয়ামল-ঙ্কিয়া” হিউয়েন সাঙ লিখেছেন তার ভ্রমণ কাহিনীতে। কথিত আছে- অতি প্রাচীনকালে কুমিল্লা’র দণিাংশে কলিঙ্গদের রাজ্য স্থাপিত হয়। তারা একে বলতেন “কমলিঙ্ক”। এই “কমলিঙ্ক”ই পরে “কমলাঙ্ক” হয়ে যায়। আর ঐ কমলাঙ্কই আজকের কুমিল্লা। কুমিল্লা তার বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বুকে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো-
শালবন বিহার ঃ
৫ম শতাব্দীতে কুমিল্লা গুপ্ত সম্রাটদের শাসনে ছিল। বাংলাদেশের এ পর্যন্ত জানা অন্যতম প্রাচীন বৌদ্ধবিহার কুমিল্লার গুনাইঘরে। কুমিল্লা শহরের ৫ মাইল পশ্চিমে প্রায় ১২ মাইল লম্বা, আধা থেকে ৩ মাইল প্রস্থ লালমাই পাহাড় শ্রেণী প্রায় গড়ে ৫০ মাইল উঁচু। এ অঞ্চলে প্রায় ৮টি রাজত্বের ইতিহাস পাওয়া যায়। বৌদ্ধদের বংশীয় রাজাদের সময় (৭ম-৮ম) শতাব্দীতে শালবন বিহার স্থাপিত হয়। এর কেন্দ্র স্থলে একটি মন্দিরকে ঘিরে বর্গাকার এই বিহারের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৫৫০ ফুট। বিহারের চার বাহুতে মোট ১১৫টি ক আছে। বিহারের মাঝামাঝি এই মন্দির ক্রুশ আকৃতির। প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৭০ ফুট। বিহারের চারদিকের বেষ্টনি প্রাচীর ১৬.৫ ফুট পুরু, চারদিকে কগুলোর দেয়াল ৫ ফুট পুরু, আয়তন ১২দ্ধ১১ ফুট, সামনে ৮.৫ ফুট পুরু চওড়া টানা বারান্দা। 
 ময়নামতি জাদুঘর ঃ
শালবহন বিহার সংলগ্ন গড়ে উঠেছে ময়নামতি জাদুঘর। এ জাদুঘরে রয়েছে কাঠের তৈরী নিপুণ কারুশিল্প, তামা ও কাসার বিভিন্ন জিনিসপত্র, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, পোড়ামাটির দ্রব্য, উপজাতীয়দের জীবনভিত্তিক নিদর্শন, লোহার তৈরী বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্রসহ কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধারকৃত পুরানর্কীতি ও তার অংশ বিশেষ। 
 বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) ঃ
গ্রাম উন্নয়নে “কুমিল্লা মডেল” হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। গ্রামন্নায়নের শতমুখী সমস্যা হতে উত্তরণের পথ বের করার জন্য গুরুত্ব দেয়া এই একাডেমীর মূল বৈশিষ্ট্য। দশজন উচ্চ প্রশিণ প্রাপ্ত সদস্য নিয়ে ১৯৫৮ সালের ২৭ মে একাডেমীর কাজ শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে এর কোটবাড়ীতে স্থায়ী কার্যালয় স্থাপিত হয়। বার্ডটির প্রথম পরিচালক ছিলেন আখতার হামিদ খান। এশিয়ার মধ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো প্রশিণ ও ওরিয়েন্টেশন, গবেষণা ও মূল্যায়ন, গ্রাম উন্নয়নে নিরীা। এই সার্বিক কার্যক্রম থেকে গ্রাম উন্নয়ন প্রসঙ্গে বেশ কিছু মৌলিক ধারনা পাওয়া গেছে। দর্শন নিতে পারের বার্ডের ছায়া-ডাকা নিবির বৃরাজির। বার্ডের ভিতরে ডান দিকের রাস্তা দিয়ে একটু সামনে গেলেই দেখতে পারবেন নিশাচর পাহাড়। উক্ত পাহাড়ে পা রেখে উপভোগ করতে পারের পুরু লালমাই এলাকা।
 ওয়ার সিমেটারি ঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুমিল্লা অঞ্চলটি ছিল বৃটিশ বাহিনীর ঘাঁটি। ময়নামতিতে ছিলো এয়ার ফিল্ড, আহত সৈনিকদের জন্য হাসপাতাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যত বিদেশী সৈন্য নিহত হতো তাদেরকে এই খানে সমাধি দেওয়া হত। বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, পাকশী, সৈয়দপুর, শান্তাহার ুদ্র সিমেটারিতে যে সব সৈন্যের সমাধি ছিল সেগুলো পরবর্তীতে কুমিল্লায় হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে এতে মোট সমাধির সংখ্যা ৭৩৭। সমাধিতে শায়িত সৈন্যদের মধ্যে বৃটিশ ৩৫৭, ভারতীয় ১৭৮, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন। বর্তমানে তা কুমিল্লা বিরিসিরি অষ্ট্রেলিয়ান ব্যপ্টিস্ট মিশন দ্বারা পরিচালিত।
 রামমালা পাঠাগার ঃ
রামমালা পাঠাগার বিরল, দু®প্রাপ্য, মূল্যবান গ্রন্থ সমৃদ্ধিতে দেশের অন্যতম। এই গ্রন্থাগারের পুঁথি সংগ্রহ বিখ্যাত। হাতের লেখা এই সব পুঁথি কাপড় জড়িয়ে কাঠের পাঠা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। প্রাচীন এসব পুঁথিকে কলমী পুঁথি বলা হয়। জেলা শহরের লাকসাম রোডে ঈশ্বর পাঠশালা সংলগ্ন এ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা দানবীর স্বর্গীয় মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। রামমালা পাঠাগারে তিনটি বিভাগ আছে। গবেষণা, পুঁথি ও সাধারণ বিভাগ। এখানে সাড়ে ৮ হাজারের মতো পুঁথি রয়েছে। এগুলো গবেষণা, উন্নয়ন কাজ, সমাজ-সভ্যতা, জীবনযাপন, জীবনাচরণ সম্পর্কে পরিচিত হতে সাহায্য করবে দর্শনার্থীকে। অধিকাংশ পুঁথি সংস্কৃতি ভাষায়, কিছু আছে বাংলায়। পুঁথিগুলো মূলত কাব্য, কোষ, সংস্কৃত, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ ও ইতিহাস। 
 সাধারণ বিভাগে গল্প, উপন্যাস, জীবনী, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ের গ্রন্থাদি ছাড়াও ইংরেজী সাহিত্য, রামকৃষ্ণ, গান্ধী ও স্বরূপানন্দের উপর তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তক রয়েছে। এখান থেকে সহযোগিতা নিয়েই তৎকালীন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের শিক দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। বর্তমানে পুঁথিগুলোকে মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুক্রবার ও সরকারী ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০-১টা এবং বিকাল ৪-৬টা পর্যন্ত সকল গ্রন্থাগার পাঠকের জন্য এটি উন্মুক্ত থাকে। তথ্যসন্ধানী আগ্রহী যেকোনো পাঠক চলে আসতে পারেন রামমালা গ্রন্থাগারে। সংগ্রহ করে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় তথ্য। 
এই সব ছাড়াও আপনাকে আনন্দ দিতে পারে কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগর, তার পাশের পৌর উদ্যান বা ত্রিপুরা রাজ্যের বিশ্রামস্থল রাণীর কুঠি, শহরের মোগলটুলীর শাহসুজা মসজিদ, প্রাচীন শিা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজ, বোটানিকাল গার্ডেন, চন্ডিমুড়া, আনন্দ বাজার দীঘি। যেখানে বসে সঙ্গীত চর্চা করতেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, গান গেয়ে মজলিশ জমাতেন শচীন দেব বর্মন আর কাজী নজরুল ইসলাম, যেখানে বসে শিক দীনেশ চন্দ্র সেন রচনা করেছেন বাংলা ভাষার সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস, ১৯৪৮ সালে পার্লামেন্টে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রিয় ভাষা করার জন্য যে সর্ব প্রথম দাবী তোলের সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মভূমি কুমিল্লা কি কেউ না দেখে তৃপ্তি মিটাতে পারে? বেড়ানোর উদ্যোশে কুমিল্লার আসলে বেড়ানোর পাশাপাশি কুমিল্লার ঐতিহ্য রসমালাই খেতে ভুলবেন না কিন্তু।

লেখক,
সাংবাদিক ও ভ্রমণ লেখক
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা।

Friday, July 22, 2016

অপূর্ব নীলিগিরি

বাংলার অপূর্ব নিদর্শন নীলগিরি

নাজমুল করিম ফারুক
ছবি- অরূপ নীলগিরি পাহাড় ঘেরা মেঘের ভেলা
হ্যাঁ, পাহাড় ঝরনা আর মেঘের সাথে মিতালীর প্রবল ইচ্ছা থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম এবারের ভ্রমণটা হবে বান্দরবানের নীলগিরি। অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ১৪ নভেম্বর’১৫ বিকাল ৩টায় মাইক্রোবাস নিয়ে রওনা হলাম আমরা ঘুরি সারা বাংলাদেশ শিরোনামে ১০ সদস্যের একটি দল। চট্টগ্রামের এক রাত বিরতি দিয়ে ১৫ নভেম্বর বিকালে বান্দরবান জেলা শহরে গিয়ে অবস্থান করি এবং হোটেল প্যারাডাইসে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত হয়। রাতেই নীলগিরি যাওয়ার জন্য চাঁন্দের গাড়ি ভাড়া করা হয়। ভোর ৫টায় রওনা দিতে হবে তাই ঘুমাতে তারাও আছে। তারপরও রাত সাড়ে ১২টার আগে কেউ ঘুমাতে পারিনি। 
ছবি- অরূপ নীলগিরি পাহাড় ঘেরা মেঘের ভেলা
কাক ডাকা ভোর। হোটেলের জানালে খুলে দেখা গেলো চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছান্ন। চাঁন্দের গাড়ি এসে হাজির, শুধু হাজির হয়নি আমরা। একে একে সবায়কে হোটেল থেকে বাহির করে যখন নিজে প্রস্তুতি নিতে ছিলাম তখন ফোন বাঁজছে তো বাঁজছে। তাড়াতাড়ি রওনা হলাম চাঁন্দের গাড়ি চড়ে। কনকনে শীত, ঠান্ডা হিমেল হাওয়া, প্রথমে কুয়াশা মনে হলেও চাঁন্দের গাড়ির ড্রাইভার মনের ভুল ভেঙ্গে দিয়ে বললো এগুলো মেঘ। অবাক করা দৃশ্য আর অনুভূতি। 
ছবি- অরূপ নীলগিরি পাহাড় ঘেরা মেঘের ভেলা
মেঘের ভেতর দিয়ে আমরা শুধু উপড়ে উঠছি আর নামছি। উঠছি আর নামছি। বান্দরবান শহর থেকে যখন আমরা পাহাড়ি পথ ধরে নীলগিরি দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখনও পাহাড়ি জনপথে কোন পাহাড়ি জনগণ চোখে পড়েনি। মনে হচ্ছে একটু পড়ে ঘুম ভাঙ্গবে। হয়তো যার যার কাজে বাহির হবে। একদিকে বিস্তৃণ এলাকা জুড়ে মেঘের খেলা অন্যপাশে মনে হয় কত নীচে। ভয়ঙ্কর অনুভূতি। এক পাহাড়ি মহিলা তার কুঁড়ে ঘর থেকে বাহির হয়েছে কলার হানা নিয়ে বাজারে যাবে কিন্তু বিধিবাম, কত টাকা, দেন। গাড়িতে বেঁধে চলছে কলা খাওয়ার মহাউৎসব। 
ছবি- এ পথটাই আপনাকে নিয়ে যাবে নীলগিরি
আঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে আমরা যখন চিম্বুক সেনা ক্যাম্পে হাজির কখন আমাদের সামনে হাজির হলো সকালের নাস্তা ভূনা খিচরি আর ডিম। অসাধারণ রান্না। নাস্তার পাশাপাশি চিম্বুক সূর্যদয়ে চলে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। পেছনে বিস্তৃণ এলাকা জুড়ে মেঘে ঢাকা। ভেসে আসছে শীতের কনকনে শীতল হাওয়া। সকালের নাস্তাটা সেরে রওনা হলাম আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে নীলগিরি দিকে। পেটে যখন খানা পড়েছে মনে তখন আনন্দ এসেছে। গাইতে লাগলো পাঁচমিশালী গান। অসাধারণ অনুভূতি। কখন যাবো নীলগিরি। হই হুলুর আর গানে এক পর্যায়ে পৌছে গেলাম স্বপ্নের নীলগিরি। 
ছবি- সত্যিই অসাধারণ এক নীলগিরি
দৌড়ে উপরে উঠলাম আর দেখলাম প্রাকৃতির লীলাখেলা। সত্যিই কি মেঘের উপরে আমরা! ঘুরা ঘুরি ছুটাছুটি আর ছবি তোলা। একটু বলে রাখি, সমুদ্র পিষ্ঠ হতে ২২০০ ফুট উচ্চতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত এ নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রটি পাহাড় এবং আকাশের মিতালীর এক অপূর্ব নিদর্শন। সকাল ও বিকালে মেঘের খেলা বিরাজ করলেও দুপুরে আকাশ পরিস্কার থাকলে এখান থেকে খালি চোখে বঙ্গোপসাগরে জাহাজ চলাচলের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। মাথার উপরে সূর্য্য উকি দিচ্ছে আর মেঘেরা পালিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম কিভাবে পাহাড় মেঘের বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। দু’ঘন্টা শেষ করে ফিরতে প্রস্তুতি নিলাম। সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত চায়ের দোকানে চা পান করে স্মৃতিস্বরূপ কিছু কেনাকাটা। চিম্বুক ও শৈলপ্রপাতের দর্শন নিয়ে চাঁন্দের গাড়ি চড়ে দুপুর ২টায় হাজির হলাম বান্দরবান শহরে। 

লেখক,
সাংবাদিক ও ভ্রমণ লেখক 
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিলা।

Thursday, July 21, 2016

সাজেকের পাদদেশে লুকিয়ে ঘুমায় কমলক ঝরনা

সাজেকের পাদদেশে লুকিয়ে ঘুমায় কমলক ঝরনা

নাজমুল করিম ফারুক
ছবি ঃ রুইলুং পাড়ার কমলক ঝরনা
পাহার আর ঝরনা দেখার মজাই আলাদা। লোভটা সামলানো যায় না। তাইতো এসো ঘুরে দেখি বাংলাদেশ এর কর্ণদ্বার শওকত হোসেন এর আহ্বানে যখন সাড়া দিলাম তখন তিনিও একপটে আমাকে যুক্ত করে নিলেন। এবারের ঈদে খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক; দীঘিনালা-লংগদু হয়ে রাঙ্গামাটি ভ্রমণটা অনেকটা অন্যান্য ভ্রমণের চেয়ে আনন্দদায়ক তো বটেই এবং বিশাল অভিজ্ঞতার ভান্ডার। 
ঢাকা থেকে ১২জনের টিম রাতের বাসে রওনা দিয়ে আমরা ভোরেই পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ি। শাপলা চত্ত্বরে নাস্তা সেরে চাঁন্দের গাড়ি চড়ে আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গ, বৌদ্ধবিহার, রিছাং ঝরণা, অপু ঝরনা ও জেলা পরিষদের পার্ক দর্শন শেষে দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি-কাসলং-মাসালং পথ ধরে সাজেকে। সমতল ভূমি শেষ হয়ে যখন পাহাড়ের চড়াই-উতরাই শুরু তখনই পাল্টে যাচ্ছে দৃশপট। যতই পথ চলা ততই সবুজের সমারোহ। ভয়ংকর টানিং আর আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ; প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাঁড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামা, কিংবা ওপরে ওঠার সময় যতটা রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে ততটা মনে হয়েছে অ্যাডভেঞ্চারকর। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১৮শ ফুট উঁচুতে সাজেক ভ্যালি। এখানে মুলত রুইলুই ও কংলাকদের বসতি। রাঙ্গামাটির জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক একটি ইউনিয়ন। ুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাংখোয়াদের বসতি এখানে। বিকালে সাজেকের সূর্যাস্ত আর সকালে সূর্যদয় সেই সাথে মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলা শেষে কিছু সময় রয়েছে আমাদের হাতে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সাজেকের পাদদেশে অবস্থিত কমলক ঝরনা দেখার। যার আরেক নাম পিদাম তৌসা। ঝরনায় যাওয়ার পথের প্রাথমিক ধারনা নিতে গিয়ে ছটকে পড়লেন আমাদের ৬ সদস্য। গহিন পাহাড়ি জঙ্গল, সোজা নিচে নেমে যাওয়া আবার উঠা, তারমধ্যে জোঁকের আক্রমণ তাই দ্বিমত। 
ছবি ঃ রুইলুং পাড়ার কমলক ঝরনা।
রুইলুইপাড়ার কংলাক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছন দিয়ে পাহাড় থেকে সে পথটি নিচে নেমে গেছে এটা দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু তবে সাজেকের ২ নাম্বার হেলিপ্যাডের পাশ থেকেও কমলক ঝরনায় যাওয়া যায়। রুইলুইপাড়ার বিতরাম দা’র সহযোগিতায় তারই বাবা শুদ্ধ বসন ও তার ৬ বছরের ছেলে মনেদ বাবুকে নিয়ে আমিসহ টিম লিডার শওকত হোসেন, সিদ্দিকুর রহমান, নেপাল পন্ডিত, কার্তিক বিশ্বাস ও ইরফান আহম্মেদ রওনা হলাম।
পাহাড়ের এলোমেলো ঝোপঝাড় সামনে থেকে সরিয়ে আমাদের যাওয়ার রাস্তা সুগম করতে ব্যস্ত গাইড শুদ্ধ বসন তারপাশেই ৬ বছরের শিশু মনেদ বাবু। দাদার সাথে বায়না ধরেছে সাথে যাবে তাই সেও এপথের যাত্রী। প্রায় ১৫ মিনিট হাঁটার পর কানে পর্দায় ভেসে আসলো পানি পড়ার ঝিরঝির শব্দ। মনে হলো এই বুঝি কমলক ঝরনা। না, গাইড থামিয়ে দিয়ে বললো এটা ঝিরি। পেছন থেকে ইরফান ভাইয়ের আহ্বান, গাইড দাদা আমরা নামতে পারছি না আমাদের লাঠির ব্যবস্থা করে দিন। সত্যিই খাড়া পথে লাঠি ছাড়া নামা দুস্কর। গাইডও কিছুটা বিরতি নিয়ে আমাদের সবার হাতে বাঁশের লাঠি ধরিয়ে দিল। হাঁটার মাঝে অনুভব করলাম শুধু পাহাড় থেকে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি তো যাচ্ছি কিন্তু ওঠার সময় ওঠবো কি করে? মনের মধ্যে একটা অজানা আতংক রয়ে গেল। আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আবিস্কার করলাম উড়ান থেকে বেয়ে আসা পাহাড়ি জলের। বিশাল প্রস্থ ঝিরি বেয়ে নিচের দিকে পানি নেমে যাচ্ছে ছোট বড় পাথরের বাঁধা ডিঙ্গিয়ে। ভেবে ছিলাম যেদিক থেকে পানি গড়িয়ে আসছে সেদিকে ঝরনা হবে। কারণ এতো পানির স্রোত অবশ্যয় ঝরনা থেকে আসছে। না, এখানেও বিপত্তি, গাইড বললো, গড়িয়ে পড়া জলের পথ ধরেই আমাদের এগুতে হবে। একতো পিচ্ছিল পথ তার উপর বিশাল পাথরের গাঁয়ে নিজের গাঁ লাগিয়ে একটা পাথর থেকে নেমে আসা আবার আরেকটা পাথরে উঠা কি যে কষ্ট হচ্ছিল বলে শেষ করা যাবে না। একে অপরের সহযোগিতা নিয়েই এপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। ঝিরি পথের মাঝখানে গাইড আমাদের থেমে দেয় বলে সামনে এগুনো যাবে না; কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটু সামনে থেকে পানি খাড়া নিচে পড়ে যাচ্ছে যা কমলক ঝরনা। তবে আমাদের আরেকটা পাহাড় বেড়ে উপরে উঠে আবার নিচে নামলেই ঝরনার দেখা পাবো। যেকথা সেই কাজ। আবার পাহাড়ে ওঠা। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো নিজের পায়ের দিকে; জোঁকের আক্রমণ দেখে শরীরে শিহরণ জাগলো, মনে উদয় হলো ভয়। পেছনে থাকা সিদ্দিক ভাই তার কৌশল প্রয়োগ করে একটু শান্তি দিলো। কিন্তু একটা অজানা ভয় দেহের মধ্যে বাসা বেঁধে নিলো। জোঁকের অত্যাচার থেকে রা পায়নি সিদ্দিক ও ইরফান ভাই, গাইড শুদ্ধ বসন ও ৬ বছরের মনেদ বাবু। ভাগ্য ভালো সকাল থেকে বৃষ্টি হয়নি যদি বৃষ্টি হতো তাহলো জোঁকের প্রচুর আক্রমণ আমাদের সহ্য করতে হতো। প্রায় ৫৫ মিনিট পর দেখা পেলাম কমলক ঝরনার। শীতল বাতাসে বেসে আসা হিমেল জলের স্পর্শে দেহ-মন প্রশান্তি পেল। আধা ঘন্টা ঝরনায় দাপাদাপির পর পা বাড়ালাম ফিরতে পথের। নেমে যাওয়া পথে উঠে আসা যে কত কষ্টের তা অবলোকন করতে হলে পাড়ি দিতে হবে কমলক ঝরনার পথ। প্রায় তিন ঘন্টা সময় অতিবাহিত করে একটি কান্ত দেহ নিয়ে নিজেকে পুনরায় আবিস্কার করলাম রুইলুই পাড়ায়।  
ছবি ঃ কমলক ঝরনায় যাওয়ার পথে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম পাহাড়ি পথ ও পিচ্ছিল ঝিরি দিয়ে
কিভাবে যাবেন ঃ ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি বিভিন্ন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া পড়বে ৫৫০-৬০০। ঢাকা থেকে শান্তি পরিবহনে দীঘিনালাও যাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি শাপলা চত্ত্বর অথবা দীঘিনালা থেকে চান্দের গাড়ী অথবা মোটরসাইকেলে সাজেক যাওয়া যায়। চান্দের গাড়ির ভাড়া ৩৫০০-৪০০০ টাকা (যাওয়া-আসা), মোটরসাইকেলে ১২০০-১৫০০ টাকা। 

কোথায় থাকবেন ঃ যতই দিন যাচ্ছে সাজেকে থাকার ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে। এখানে আদিবাসীদের ঘরেও রাত্রি যাপন করা যায়। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এছাড়াও খাগড়াছড়ি ও দিঘিনালায় থাকতে পারেন। খরচ পড়বে জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। 

কোথায় খাবেন ঃ সাজেকে খাওয়ার জন্য আপনাকে আগে অর্ডার দিতে হবে। ইচ্ছা করলে আদিবাসীদের সহযোগিতায় নিজেদের ব্যবস্থায় রান্না করতে পারবেন। 
লেখক ঃ
নাজমুল করিম ফারুক
সাধারণ সম্পাদক 
তিতাস উপজেলা প্রেসকাব, কুমিল্লা।