Wednesday, July 27, 2016

কুমিল্লা দর্শন

কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য

নাজমুল করিম ফারুক

কুমিল্লা জেলাসহ এ অঞ্চলের ভূ-ভাগের ভিত্তিমূল স্থাপিত হয় আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি বছর আগে মায়োসীনে যুগে। সূচনা থেকে অদ্যবধি প্রায় ৪০ হাজার ফিট আস্তরনের ভিত্তিমূলে ও স্তুপী মূলে স্তূপীকৃত হয়েছে। প্রাচীনকালের মানচিত্রে দেখা যায় লোহিত (বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র) নদীর অববাহিকায় প্রাগজ্যোতিষ ও পূর্ব ভাগে পাহাড়ের পাদদেশের অঞ্চল কিরাতস নামে অভিহিত ছিল। ধারনা করা হয় এই কিরাতাসের অধিকাংশ স্থান নিয়েই গঠিত হয় সমতট অঞ্চল, পরবর্তীতে ভারত বর্ষের ত্রিপুরা, ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লা।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানী অধিকার করার পর ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দ সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা) পরগনা ব্যতীত বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার পুরো এলাকা নিয়ে একটি জেলা গঠন করা হয়। যার নামকরণ করা হয় ত্রিপুরা জেলা। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালী ও ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে নোয়াখালীর ছাগলনাইয়ার অংশ ত্রিপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ১ অক্টোরব এক প্রশাসনিক আদেশে কুমিল্লা জেলা নামে জেলার নাম অভিহিত হয়। 
 ত্রিপুরা রাজ্যের তিচ্না উর্ধ্বভাজ থেকে উৎপন্ন হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লা শহরের ৮ মাইল পূর্বে অবস্থিত বিবির বাজারের কাছে জেলায় প্রবেশ করেছে গোমতী নদী। কুমিল্লা শহরকে ছেড়ে  গোমতী নদী জাফরগঞ্জ, দেবিদ্বার, কোম্পানীগঞ্জ ও মুরাদনগর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে উত্তর-পশ্চিম দিকে। এরপর মুরাদনগর থেকে দণি-পশ্চিমে তিতাস উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দাউদকান্দির কাছে মেঘনার শাখা কলাতিয়া'তে মিশেছে। মেঘনার কলাতিয়া শাখায় গোমতী যেখানে মিশেছে, সেই মিলিত স্রোতও গোমতী নামে পরিচিত। দাউদকান্দির মাইলখানেক দক্সিণ পশ্চিমে বাঁক নিয়ে ধনাগোনা নামে শাখা সৃষ্টি করেছে। এই ধনাগোদা মতলবের পশ্চিম অংশও গোমতী নামে পরিচিত। নদী শাসনের পূর্বে গোমতী ছিল প্রশস্ত। ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে মোঘলদের নৌ-বাহিনী গোমতী বেয়ে ত্রিপুরার তৎকালীন রাজধানী উদয়পুর আক্রমন করেন। আর সেই গোমতীর তীরেই কুমিল্লা শহরটি অবস্থিত।
কুমিল্লা জেলার নামকরণ নিয়ে নানামতের মধ্যে একটি হলো- আজ থেকে ১৩৬৬ বছর (৬৩৭খ্রিঃ) আগে ভুবনশ্র“ত চৈনিক বৌদ্ধ পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষে এসেছেন। উদ্দেশ্য নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহাস্থবির শীলভদ্রের কাছে শিা গ্রহণ। সেই আচার্য শীলভদ্র’র বাড়ি “কিয়ামল-ঙ্কিয়া” হিউয়েন সাঙ লিখেছেন তার ভ্রমণ কাহিনীতে। কথিত আছে- অতি প্রাচীনকালে কুমিল্লা’র দণিাংশে কলিঙ্গদের রাজ্য স্থাপিত হয়। তারা একে বলতেন “কমলিঙ্ক”। এই “কমলিঙ্ক”ই পরে “কমলাঙ্ক” হয়ে যায়। আর ঐ কমলাঙ্কই আজকের কুমিল্লা। কুমিল্লা তার বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বুকে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো-
শালবন বিহার ঃ
৫ম শতাব্দীতে কুমিল্লা গুপ্ত সম্রাটদের শাসনে ছিল। বাংলাদেশের এ পর্যন্ত জানা অন্যতম প্রাচীন বৌদ্ধবিহার কুমিল্লার গুনাইঘরে। কুমিল্লা শহরের ৫ মাইল পশ্চিমে প্রায় ১২ মাইল লম্বা, আধা থেকে ৩ মাইল প্রস্থ লালমাই পাহাড় শ্রেণী প্রায় গড়ে ৫০ মাইল উঁচু। এ অঞ্চলে প্রায় ৮টি রাজত্বের ইতিহাস পাওয়া যায়। বৌদ্ধদের বংশীয় রাজাদের সময় (৭ম-৮ম) শতাব্দীতে শালবন বিহার স্থাপিত হয়। এর কেন্দ্র স্থলে একটি মন্দিরকে ঘিরে বর্গাকার এই বিহারের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ৫৫০ ফুট। বিহারের চার বাহুতে মোট ১১৫টি ক আছে। বিহারের মাঝামাঝি এই মন্দির ক্রুশ আকৃতির। প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৭০ ফুট। বিহারের চারদিকের বেষ্টনি প্রাচীর ১৬.৫ ফুট পুরু, চারদিকে কগুলোর দেয়াল ৫ ফুট পুরু, আয়তন ১২দ্ধ১১ ফুট, সামনে ৮.৫ ফুট পুরু চওড়া টানা বারান্দা। 
 ময়নামতি জাদুঘর ঃ
শালবহন বিহার সংলগ্ন গড়ে উঠেছে ময়নামতি জাদুঘর। এ জাদুঘরে রয়েছে কাঠের তৈরী নিপুণ কারুশিল্প, তামা ও কাসার বিভিন্ন জিনিসপত্র, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, পোড়ামাটির দ্রব্য, উপজাতীয়দের জীবনভিত্তিক নিদর্শন, লোহার তৈরী বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্রসহ কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধারকৃত পুরানর্কীতি ও তার অংশ বিশেষ। 
 বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) ঃ
গ্রাম উন্নয়নে “কুমিল্লা মডেল” হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। গ্রামন্নায়নের শতমুখী সমস্যা হতে উত্তরণের পথ বের করার জন্য গুরুত্ব দেয়া এই একাডেমীর মূল বৈশিষ্ট্য। দশজন উচ্চ প্রশিণ প্রাপ্ত সদস্য নিয়ে ১৯৫৮ সালের ২৭ মে একাডেমীর কাজ শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে এর কোটবাড়ীতে স্থায়ী কার্যালয় স্থাপিত হয়। বার্ডটির প্রথম পরিচালক ছিলেন আখতার হামিদ খান। এশিয়ার মধ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো প্রশিণ ও ওরিয়েন্টেশন, গবেষণা ও মূল্যায়ন, গ্রাম উন্নয়নে নিরীা। এই সার্বিক কার্যক্রম থেকে গ্রাম উন্নয়ন প্রসঙ্গে বেশ কিছু মৌলিক ধারনা পাওয়া গেছে। দর্শন নিতে পারের বার্ডের ছায়া-ডাকা নিবির বৃরাজির। বার্ডের ভিতরে ডান দিকের রাস্তা দিয়ে একটু সামনে গেলেই দেখতে পারবেন নিশাচর পাহাড়। উক্ত পাহাড়ে পা রেখে উপভোগ করতে পারের পুরু লালমাই এলাকা।
 ওয়ার সিমেটারি ঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুমিল্লা অঞ্চলটি ছিল বৃটিশ বাহিনীর ঘাঁটি। ময়নামতিতে ছিলো এয়ার ফিল্ড, আহত সৈনিকদের জন্য হাসপাতাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যত বিদেশী সৈন্য নিহত হতো তাদেরকে এই খানে সমাধি দেওয়া হত। বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, পাকশী, সৈয়দপুর, শান্তাহার ুদ্র সিমেটারিতে যে সব সৈন্যের সমাধি ছিল সেগুলো পরবর্তীতে কুমিল্লায় হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে এতে মোট সমাধির সংখ্যা ৭৩৭। সমাধিতে শায়িত সৈন্যদের মধ্যে বৃটিশ ৩৫৭, ভারতীয় ১৭৮, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন। বর্তমানে তা কুমিল্লা বিরিসিরি অষ্ট্রেলিয়ান ব্যপ্টিস্ট মিশন দ্বারা পরিচালিত।
 রামমালা পাঠাগার ঃ
রামমালা পাঠাগার বিরল, দু®প্রাপ্য, মূল্যবান গ্রন্থ সমৃদ্ধিতে দেশের অন্যতম। এই গ্রন্থাগারের পুঁথি সংগ্রহ বিখ্যাত। হাতের লেখা এই সব পুঁথি কাপড় জড়িয়ে কাঠের পাঠা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। প্রাচীন এসব পুঁথিকে কলমী পুঁথি বলা হয়। জেলা শহরের লাকসাম রোডে ঈশ্বর পাঠশালা সংলগ্ন এ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা দানবীর স্বর্গীয় মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য। রামমালা পাঠাগারে তিনটি বিভাগ আছে। গবেষণা, পুঁথি ও সাধারণ বিভাগ। এখানে সাড়ে ৮ হাজারের মতো পুঁথি রয়েছে। এগুলো গবেষণা, উন্নয়ন কাজ, সমাজ-সভ্যতা, জীবনযাপন, জীবনাচরণ সম্পর্কে পরিচিত হতে সাহায্য করবে দর্শনার্থীকে। অধিকাংশ পুঁথি সংস্কৃতি ভাষায়, কিছু আছে বাংলায়। পুঁথিগুলো মূলত কাব্য, কোষ, সংস্কৃত, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ ও ইতিহাস। 
 সাধারণ বিভাগে গল্প, উপন্যাস, জীবনী, ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ের গ্রন্থাদি ছাড়াও ইংরেজী সাহিত্য, রামকৃষ্ণ, গান্ধী ও স্বরূপানন্দের উপর তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তক রয়েছে। এখান থেকে সহযোগিতা নিয়েই তৎকালীন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের শিক দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন। বর্তমানে পুঁথিগুলোকে মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুক্রবার ও সরকারী ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০-১টা এবং বিকাল ৪-৬টা পর্যন্ত সকল গ্রন্থাগার পাঠকের জন্য এটি উন্মুক্ত থাকে। তথ্যসন্ধানী আগ্রহী যেকোনো পাঠক চলে আসতে পারেন রামমালা গ্রন্থাগারে। সংগ্রহ করে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় তথ্য। 
এই সব ছাড়াও আপনাকে আনন্দ দিতে পারে কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগর, তার পাশের পৌর উদ্যান বা ত্রিপুরা রাজ্যের বিশ্রামস্থল রাণীর কুঠি, শহরের মোগলটুলীর শাহসুজা মসজিদ, প্রাচীন শিা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজ, বোটানিকাল গার্ডেন, চন্ডিমুড়া, আনন্দ বাজার দীঘি। যেখানে বসে সঙ্গীত চর্চা করতেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, গান গেয়ে মজলিশ জমাতেন শচীন দেব বর্মন আর কাজী নজরুল ইসলাম, যেখানে বসে শিক দীনেশ চন্দ্র সেন রচনা করেছেন বাংলা ভাষার সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস, ১৯৪৮ সালে পার্লামেন্টে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রিয় ভাষা করার জন্য যে সর্ব প্রথম দাবী তোলের সেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্মভূমি কুমিল্লা কি কেউ না দেখে তৃপ্তি মিটাতে পারে? বেড়ানোর উদ্যোশে কুমিল্লার আসলে বেড়ানোর পাশাপাশি কুমিল্লার ঐতিহ্য রসমালাই খেতে ভুলবেন না কিন্তু।

লেখক,
সাংবাদিক ও ভ্রমণ লেখক
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা।

No comments:

Post a Comment