Thursday, July 21, 2016

সাজেকের পাদদেশে লুকিয়ে ঘুমায় কমলক ঝরনা

সাজেকের পাদদেশে লুকিয়ে ঘুমায় কমলক ঝরনা

নাজমুল করিম ফারুক
ছবি ঃ রুইলুং পাড়ার কমলক ঝরনা
পাহার আর ঝরনা দেখার মজাই আলাদা। লোভটা সামলানো যায় না। তাইতো এসো ঘুরে দেখি বাংলাদেশ এর কর্ণদ্বার শওকত হোসেন এর আহ্বানে যখন সাড়া দিলাম তখন তিনিও একপটে আমাকে যুক্ত করে নিলেন। এবারের ঈদে খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক; দীঘিনালা-লংগদু হয়ে রাঙ্গামাটি ভ্রমণটা অনেকটা অন্যান্য ভ্রমণের চেয়ে আনন্দদায়ক তো বটেই এবং বিশাল অভিজ্ঞতার ভান্ডার। 
ঢাকা থেকে ১২জনের টিম রাতের বাসে রওনা দিয়ে আমরা ভোরেই পৌঁছে গেলাম খাগড়াছড়ি। শাপলা চত্ত্বরে নাস্তা সেরে চাঁন্দের গাড়ি চড়ে আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গ, বৌদ্ধবিহার, রিছাং ঝরণা, অপু ঝরনা ও জেলা পরিষদের পার্ক দর্শন শেষে দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি-কাসলং-মাসালং পথ ধরে সাজেকে। সমতল ভূমি শেষ হয়ে যখন পাহাড়ের চড়াই-উতরাই শুরু তখনই পাল্টে যাচ্ছে দৃশপট। যতই পথ চলা ততই সবুজের সমারোহ। ভয়ংকর টানিং আর আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ; প্রায় ৬০ ডিগ্রি খাঁড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামা, কিংবা ওপরে ওঠার সময় যতটা রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে ততটা মনে হয়েছে অ্যাডভেঞ্চারকর। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১৮শ ফুট উঁচুতে সাজেক ভ্যালি। এখানে মুলত রুইলুই ও কংলাকদের বসতি। রাঙ্গামাটির জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক একটি ইউনিয়ন। ুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাংখোয়াদের বসতি এখানে। বিকালে সাজেকের সূর্যাস্ত আর সকালে সূর্যদয় সেই সাথে মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলা শেষে কিছু সময় রয়েছে আমাদের হাতে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম সাজেকের পাদদেশে অবস্থিত কমলক ঝরনা দেখার। যার আরেক নাম পিদাম তৌসা। ঝরনায় যাওয়ার পথের প্রাথমিক ধারনা নিতে গিয়ে ছটকে পড়লেন আমাদের ৬ সদস্য। গহিন পাহাড়ি জঙ্গল, সোজা নিচে নেমে যাওয়া আবার উঠা, তারমধ্যে জোঁকের আক্রমণ তাই দ্বিমত। 
ছবি ঃ রুইলুং পাড়ার কমলক ঝরনা।
রুইলুইপাড়ার কংলাক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছন দিয়ে পাহাড় থেকে সে পথটি নিচে নেমে গেছে এটা দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু তবে সাজেকের ২ নাম্বার হেলিপ্যাডের পাশ থেকেও কমলক ঝরনায় যাওয়া যায়। রুইলুইপাড়ার বিতরাম দা’র সহযোগিতায় তারই বাবা শুদ্ধ বসন ও তার ৬ বছরের ছেলে মনেদ বাবুকে নিয়ে আমিসহ টিম লিডার শওকত হোসেন, সিদ্দিকুর রহমান, নেপাল পন্ডিত, কার্তিক বিশ্বাস ও ইরফান আহম্মেদ রওনা হলাম।
পাহাড়ের এলোমেলো ঝোপঝাড় সামনে থেকে সরিয়ে আমাদের যাওয়ার রাস্তা সুগম করতে ব্যস্ত গাইড শুদ্ধ বসন তারপাশেই ৬ বছরের শিশু মনেদ বাবু। দাদার সাথে বায়না ধরেছে সাথে যাবে তাই সেও এপথের যাত্রী। প্রায় ১৫ মিনিট হাঁটার পর কানে পর্দায় ভেসে আসলো পানি পড়ার ঝিরঝির শব্দ। মনে হলো এই বুঝি কমলক ঝরনা। না, গাইড থামিয়ে দিয়ে বললো এটা ঝিরি। পেছন থেকে ইরফান ভাইয়ের আহ্বান, গাইড দাদা আমরা নামতে পারছি না আমাদের লাঠির ব্যবস্থা করে দিন। সত্যিই খাড়া পথে লাঠি ছাড়া নামা দুস্কর। গাইডও কিছুটা বিরতি নিয়ে আমাদের সবার হাতে বাঁশের লাঠি ধরিয়ে দিল। হাঁটার মাঝে অনুভব করলাম শুধু পাহাড় থেকে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছি তো যাচ্ছি কিন্তু ওঠার সময় ওঠবো কি করে? মনের মধ্যে একটা অজানা আতংক রয়ে গেল। আধা ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আবিস্কার করলাম উড়ান থেকে বেয়ে আসা পাহাড়ি জলের। বিশাল প্রস্থ ঝিরি বেয়ে নিচের দিকে পানি নেমে যাচ্ছে ছোট বড় পাথরের বাঁধা ডিঙ্গিয়ে। ভেবে ছিলাম যেদিক থেকে পানি গড়িয়ে আসছে সেদিকে ঝরনা হবে। কারণ এতো পানির স্রোত অবশ্যয় ঝরনা থেকে আসছে। না, এখানেও বিপত্তি, গাইড বললো, গড়িয়ে পড়া জলের পথ ধরেই আমাদের এগুতে হবে। একতো পিচ্ছিল পথ তার উপর বিশাল পাথরের গাঁয়ে নিজের গাঁ লাগিয়ে একটা পাথর থেকে নেমে আসা আবার আরেকটা পাথরে উঠা কি যে কষ্ট হচ্ছিল বলে শেষ করা যাবে না। একে অপরের সহযোগিতা নিয়েই এপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। ঝিরি পথের মাঝখানে গাইড আমাদের থেমে দেয় বলে সামনে এগুনো যাবে না; কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটু সামনে থেকে পানি খাড়া নিচে পড়ে যাচ্ছে যা কমলক ঝরনা। তবে আমাদের আরেকটা পাহাড় বেড়ে উপরে উঠে আবার নিচে নামলেই ঝরনার দেখা পাবো। যেকথা সেই কাজ। আবার পাহাড়ে ওঠা। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো নিজের পায়ের দিকে; জোঁকের আক্রমণ দেখে শরীরে শিহরণ জাগলো, মনে উদয় হলো ভয়। পেছনে থাকা সিদ্দিক ভাই তার কৌশল প্রয়োগ করে একটু শান্তি দিলো। কিন্তু একটা অজানা ভয় দেহের মধ্যে বাসা বেঁধে নিলো। জোঁকের অত্যাচার থেকে রা পায়নি সিদ্দিক ও ইরফান ভাই, গাইড শুদ্ধ বসন ও ৬ বছরের মনেদ বাবু। ভাগ্য ভালো সকাল থেকে বৃষ্টি হয়নি যদি বৃষ্টি হতো তাহলো জোঁকের প্রচুর আক্রমণ আমাদের সহ্য করতে হতো। প্রায় ৫৫ মিনিট পর দেখা পেলাম কমলক ঝরনার। শীতল বাতাসে বেসে আসা হিমেল জলের স্পর্শে দেহ-মন প্রশান্তি পেল। আধা ঘন্টা ঝরনায় দাপাদাপির পর পা বাড়ালাম ফিরতে পথের। নেমে যাওয়া পথে উঠে আসা যে কত কষ্টের তা অবলোকন করতে হলে পাড়ি দিতে হবে কমলক ঝরনার পথ। প্রায় তিন ঘন্টা সময় অতিবাহিত করে একটি কান্ত দেহ নিয়ে নিজেকে পুনরায় আবিস্কার করলাম রুইলুই পাড়ায়।  
ছবি ঃ কমলক ঝরনায় যাওয়ার পথে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম পাহাড়ি পথ ও পিচ্ছিল ঝিরি দিয়ে
কিভাবে যাবেন ঃ ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি বিভিন্ন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া পড়বে ৫৫০-৬০০। ঢাকা থেকে শান্তি পরিবহনে দীঘিনালাও যাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি শাপলা চত্ত্বর অথবা দীঘিনালা থেকে চান্দের গাড়ী অথবা মোটরসাইকেলে সাজেক যাওয়া যায়। চান্দের গাড়ির ভাড়া ৩৫০০-৪০০০ টাকা (যাওয়া-আসা), মোটরসাইকেলে ১২০০-১৫০০ টাকা। 

কোথায় থাকবেন ঃ যতই দিন যাচ্ছে সাজেকে থাকার ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে। এখানে আদিবাসীদের ঘরেও রাত্রি যাপন করা যায়। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এছাড়াও খাগড়াছড়ি ও দিঘিনালায় থাকতে পারেন। খরচ পড়বে জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। 

কোথায় খাবেন ঃ সাজেকে খাওয়ার জন্য আপনাকে আগে অর্ডার দিতে হবে। ইচ্ছা করলে আদিবাসীদের সহযোগিতায় নিজেদের ব্যবস্থায় রান্না করতে পারবেন। 
লেখক ঃ
নাজমুল করিম ফারুক
সাধারণ সম্পাদক 
তিতাস উপজেলা প্রেসকাব, কুমিল্লা।

No comments:

Post a Comment