অসাধারণ এক বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’
... নাজমুল করিম ফারুক
আমি কি করবো তা বুঝতে পারি না। টাকার জন্য আমি চুরি ডাকাতি করতে গেছি, আমি অনায়াসে নিয়েছি মানিক সাহার চার নম্বর বউ ঝুমুরকে। আমার গোটা জীবনে কোনো নৈতিকতা নেই। উপরন্তু আমার আছে কালব্যাধির মতো একটা খিদে। যখন খিদে মিটে যায় তখনো আবার খিদের চিন্তা থাকে, ভয় থাকে। ক্যানসারের মতো, কুষ্ঠের মতো সেই খিদে কখনো সরে না।
আমার বিবেক তার বাদ্যযন্ত্রে একটা পিড়িং শব্দ তুলে বলে- এখনো অনেক টাকা রয়ে গেল তোমার উপলচন্দোর। তুমি যে হ্যান্ডবিলের মতো টাকা ওড়াতে চেয়েছিলে।
ঠিক। ঠিক। আমি মাথা নাড়ি।
একমুঠো টাকা বান্ডিল থেকে খুলে এনে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিই বাইরে। ঠিক অবিকল হ্যান্ডবিলের মতো বাতাসের ঝটকায় টাকা উড়ে যায়। ঘুড়ির মতো লাট খায় শুন্যে। তার আলোকিত রাস্তাঘাট আর মানুষজনের উপর নেমে আসে।
গাড়ীর পেছনের কাঁচ দিয়ে আমি ঘুুরে দেখি। মানুষজন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দৌঁড়াচ্ছে টাকার দিকে। চলন্ত ট্রাম বাস থেকে নেমে পড়ছে রাশি রাশি মানুষ। একটা লোক চলন্ত গাড়ির নীচে চলে গেল টাকা কুড়োতে গিয়ে।
আর এক মুঠো উড়িয়ে দিই। দেখি। দোকান ছেড়ে নেমে আসছে দোকানী। হাড়কাটা গলির ভাড়াটে মেয়েরা খদ্দের ভুলে পিলপিল করে রঙিন মুখ আর তেল-সিঁদুরের ছোপ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। একটা ঠ্যাং ভাঙা লোক টানা রিক্সায় বসে মেডিকেল কলেজে যাচ্ছিল, সে হঠাৎ দু’পায়ে লাফ মারল রাস্তায়।
বৌবাজারের মোড় পেরিয়ে আর একমুঠো ওড়াই।
ট্যাক্সিওয়ালা ট্যাক্সি থামিয়ে বলে- কি হচেছ বলুন তো পিছনে?
- কিছু না। আপনি চলুন।
ট্যাক্সিওলা আবার গাড়ি ছাড়ে। আমি টাকা ওড়াতে থাকি। আমার পিছু পিছু কলকাতা পাগল হতে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি ভুলে লাফিয়ে পড়ে রাস্তায়। সিনেমা ভেঙে যায়। দোকানে বাজারে ঝাঁপ পড়তে থাকে। দাঙ্গা লেগে যায়। ট্র্যাফিক জ্যাম সৃষ্টি হতে থাকে। একটা কালো পুলিশের গাড়ি ধেয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। আমি পাত্তা দিই না। চৌরঙ্গীর মোড়ে আমি মহানন্দে টাকা ছড়াই।
টাকা ওড়ে। লট খায়। পড়ে।
(খিদের ভয়কে জয় করে গল্পের মূল চরিত্র উপল অর্থ্যাৎ উপলবাবু টাকা উড়িয়ে সারা কলকাতাতে লংঙ্কাকান্ড ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে)।
ক্ষণা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল- তুমি ছাড়া আর কেউ কখনো আমাকে এত সুন্দর দেখেনি। কখনো বলেনি- তুমি বড় সুন্দর।
-তুমি সুন্দর ক্ষণা। বলে ক্ষণার কোমরের দিকে হাতটা আলতোভাবে জড়াই। বলি- সকলের কি সৌন্দর্য দেখবার চোখ থাকে?
ক্ষণা অন্যমনষ্ক বসে রইল একটু। তারপর বলল- তোমার বন্ধু কখনো আমাকে সুন্দর দেখে না। ও আমাকে দেখলই না ভাল করে, নিলও না। বিয়ের পর থেকেই দেখছি, ও বড় কাজের মানুষ। আমরা হানিমুনে যাইন, এমন কি সিনেমা থিয়েটার বেড়ানো কিছুই নয়।
গম্ভীর থেকে বলি- মহৎ মানুষরা ওরকমই হয় বোধ হয়। আমি সে তুলনায় কত সামান্য।
ক্ষণা মাথা নেড়ে বলল- না। তুমি সামান্য নও। যদি তাই হতে তা তোমাকে এত ভালবাসলাম কি করে? তোমার ভেতর একটা কি যেন আছে, ঠিক বোঝা যায় না, কিন্তু সুন্দর কি যেন আছে। তুমি নিজে বোঝ না?
(উপলবাবু বন্ধু সুবিনয়। সুবিনয়ের স্ত্রী ক্ষণা দুই সন্তানের জননী। সুবিনয় প্রীতিকে পাওয়ার জন্য উপলবাবুকে টাকা দেয়, যেন ক্ষণাকে সে নষ্ট করে। ক্ষণা নষ্ট হয়ে সুবিনয়কে ডির্ভোস দিলে সুবিনয় প্রীতিকে বিয়ে করবে। তাই উপলবাবু ক্ষণার সাথে প্রেমের অভিনয় করলেও ক্ষণা সত্যিই উপলবাবুকে ভালোবেসে ফেলে, বিলিয়ে দেয় দেহ-মন)।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি- কি করবে ক্ষণা?
-কি আর করব? যত যাই হোক, ওর ঘরই তো আমাকে করতে হবে। শিউরে উঠে বলি তা কেন ক্ষণা? আমি তোমাকে নিয়ে যাবো এখান থেকে।
ক্ষণা মাথা নেড়ে বলে- তা কি হয়?
-কেন হবে না?
-আমার ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে যে!
-তাকে কি? নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করবে? সুবিনয়ও দেখো একদিন বড় চাকরি পেয়ে চলে যাবে। আর আসবে না, খোঁজও করবে না। সেদিনের জন্য তৈরী থাকা ভাল ক্ষণা।
ক্ষণা আমার হাত ধরেই ছিল। সেই ধরা হাতটা একটু শক্ত হয়ে উঠল শুধু।
(গল্পের শেষাংশে প্রীতির কৌশলের কাছে হেরে যায় সুবিনয়। নিজের ভুল বুঝতে পারে। বন্ধু উপল ক্ষণাকে নষ্ট করেছে যেনেও সুবিনয় ক্ষণাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে থাকে। কারণ- সুবিনয়ও প্রীতিকে দিনের পর দিন কোম্পানী থেকে পাওয়া ফ্লাডে নিয়ে নষ্ট করেছিল)
বড় ভাল লোক মানিক সাহা। সে নিজেও সে কথা প্রায়ই বলত- বুঝলে হে উপুল, আমি লোকটা বড় ভাল। লোকে আমারে ভয় দেখায়, বলে, একের অধিক বিবাহ বে-আইনী। একদিন নাকি আমারে জেল খাটতে হবে। কিন্তু আমি কই, জেল খাটাবো খাটাও, কিন্তু আমারে মন্দ কয়ে না কেউ। আমি তা কোনো মেয়ের সঙ্গে নষ্টামী করি নাই। বদমাইশ লোক ঘরে বউ থুয়ে অন্যের সঙ্গে নষ্টামী করে। আমি বদমাইশ না। মেয়েছেলে দেখে মাথা খারাপ হলে আমি তারে বিয়ে করে ফেলি। এইটে সাহজের কাজ, না কি ডুব দিয়ে জল খাওয়াটা সাহসের?
মাসখানেকের মধ্যে তিনটে নৌকে বেচে দিল সে জলের দরে। আটাকল আর দোকানঘর বউদের নামে লিখে দিল। বউরা কেউ মায়াকান্না কাঁদে, কেউ বিকট চেঁচিয়ে গালমন্দ করে মানিক সাহাকে। কিন্তু লোকটা নির্বিকার, কেবল বলে- কাজগুলো স খারাপ হয়েছে। আরো ক’দিন বাদে আমার কাছে গোপনে সে ঝেড়ে কাশল। বললে- তিন বিয়ে ভাল নয়, বুঝলে? অনেক ঝামেলা। তার চেয়ে এক বিয়ে ভাল।
(মানিক সাহা তার তিন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে, সকল সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে, উপলবাবুকে নিয়ে একটি দ্বীপে পাড়ি জমায়)
মানিক সাহা বিয়ে বসল। বিয়ের ঠিকঠাক হয়ে ছিল আগে থেকেই। গরিবের ঘরের শ্রীময়ী একটা কালো, অল্প বয়সী মেয়ে লাজুক হেসে মানিকের বউ হয়ে গেল। নাম ঝুমুর। মানিক আমাকে চুপিচুপি বলল- এক বিয়ে বুঝলে? এখন থেকে আর বহু বিবাহ নয়।
(অথচ, ঝুমুর উপলবাবুল প্রেমে পড়ে যায়, তার কাছে বিয়ে বসতে চায়। মানিক সাহাকে সে সহ্য করতে পারে না)
রাত বিরেতে মানকে ভাল করে ঘুমোবার আগেই উঠে আসত। চোখের সামনেই দিন দুপুরে আমাকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে যেত বাগানের দিকে। টের না পাওয়ার কথা নয় মানকের। ভাল করে দেখে শুনে সে অবশেষে একদিন গর্জন করে উঠে বলল- অসতী! অসতী!
যাদের স্বভাব খারাপ তারা টপ করে পায়ে ধরতে পারে। ঝুমুরও পায়ে ধরে কান্নাকাটি করল। প্রথম বলল- ভল দেখেছো। পরে স্বীকার হয়ে বলল- আর হবে না এরকম।
কিন্তু তাই কি হয়! যা হওয়ার তাই হচ্ছিল ফের।
এবার মানিক সাহা কেঁদে উঠল এক রাতে। বউয়ের হাত পায়ে ধরে বিস্তর বোঝাল। ঝুমুরও কাঁদল, আদর করে বলল- তোমায় ছুঁয়ে বলছি, আর হবে না।
আবার হল।
তৃতীয় দফায় মানিক সাহা একদিন বউকে বেধড়ক ঠেঙাল, তারপর দেড় বেলা বেঁধে রাখল ঘরে। কি জানি কেন এ ব্যাপারে আমাকে তেমন কিছু বলত না মানিক। মাঝে মাঝে কেবল ছানি পড়া চোখের মতো যেন ঠাহর করতে পারছে না, এমনভাবে তাকাত। এক আধবার করুণ স্বরে জিজ্জেস করেছে- উপলভাই, এর চেয়ে কি তিন বিয়েই ভাল ছিল?
আমি তার কি জানি। চুপ করে থাকতাম।
সে নিজেই ভেবেচিন্তে বলত- তিনটে বউ থাকলে সুবিধে এই যে, তারা পর পুরুষের কথা ভাববার সময় পায় না, একটাকে নিয়েই কাড়াকাড়ি করে। হিংসুক জাত তো! এক বিয়ে দেখছি বিস্তর ঝামেলা।
(সত্যিই অসাধারণ এক বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’। আমার জীবনে যদি কোন উপন্যাস একাধিকবার পড়ে থাকি তাহলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কাগজের বউ’)।