Friday, August 5, 2016

বন্ধু কেমন আছো; আজও ভুলতে পারিনি তোমায়

খোলা চিঠি

৭ আগষ্ট’২০১৬ আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস। সময়ের আবর্তনে কালে কালে এদিবসটি ফিরে আসে বারবার। কিন্তু যাকে ঘিরে আমার বন্ধুত্বের স্বপ্ন বুনা সেই মনের মানুষের কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা স্মৃতিমাখা মুখখানি কি ভুলা যায়? তাইতো এমন দিনে মনে পড়ে তার কথা; চোখের সামনে ভেসে উঠে কোমল হাতের ভালোবাসার নিষ্পাপ স্পর্শের আলতো ছোঁয়া। সত্যিই আজও তোমাকে ভুলতে পারিনি, খুব জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছো নিগার? 
                                              ২০০৫ সালের ৩ আগষ্ট দৈনিক প্রথম আলো’তে ছাপা একটি ফিচার
নিগার,
শিশির ভেজা সিগ্ধ সকালের মায়াবী কুয়াশার পরশ রাঙিয়ে পূর্ব আকাশে অনেক স্বপ্নের ফুলঝুঁড়ি নিয়ে পৃথিবীর আকাশে উদয় হয় সূর্য কিরণের। কিন্তু শুধু উদয় হও না আমার মনের আকাশে তুমি। মেঘের কালো বিমূখে নিজেকে আড়াল করে রাখলে নিজের মতো অভিনয় করে। সূর্যের মতো নিজ থেকেই উঁকি দিলে আমার জরাজীর্ণ পৃথিবীতে। আমি বাঁধা দেয়নি, তাইতো ভালোবাসার আভা ছড়ালে সূর্যের মতো। উজ্জ্বল হলো আমার চারপাশ, আলোকিত হলো হৃদয়।  
তোমাকে নিয়ে আপন খেয়ালে ডুবে থাকতে খুব ভালো লাগে। সুযোগ পেলে তাই ভাবনার অতলে ডুব দেই। তখন নিজেকে রাখি ঘরকুনো করে। আবার কখনও কখনও মন হয়ে যায় পারাবতের মতো। মনে হয়, ডানা মেলে নীল আকাশ স্পর্শ করি, ছুটে যাই তোমার মাঝে। কিন্তু ভাবনাগুলো খুব বেশি ডালপালা মেলার সুযোগ পায় না। নিজেকে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা জগত সংসারে ফিরে আসতে হয়। তারপরও একাতিত্বের কাছে বারবার হেরে যাই। যে একাতিত্বকে আমি কুঁড়িয়ে নিয়ে ছিলাম অসম জীবনের বাঁকে। পৃথিবীর একপ্রান্তে যখন আজ আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি তখনই মনে হচ্ছে এটাই ছিল আমার প্রথম ভুল। ভুল মানুষের সংসারে ভুল মানুষ হয়েই রইলাম। দেখলো না কেউ, জানলো না কেউ, নীরবে কেঁদে গেলাম।
কান্নাই তো আমার ঘর-সংসার, দুঃখ আমার সাজনো বাগান, কষ্ট আমার পরিপাটি, চোখের জল দেহের অলংকার, কাউকে বুঝতে দেয়নি। গম্ভীরতা আর নীরবতা ছিল আমার নিত্য সঙ্গী। প্রথম বেলাতে হৃদয়ে যাকে ঠাঁই দিয়েছিলাম চার বেহারার পালকী করে তাকে তো বাড়ীর পাশের কবরস্থানে লুকিয়ে রেখেছি। বারবার চেষ্টা করেছি, তাকে বুঝাতে ‘আমি তোকে ভালোবাসি, শুধু তোকে ভালোবাসি’। আমার চাওয়া-পাওয়ার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সে নিজেই সলিল সমাধি হয়ে গেল, নিজের মতো করে। আমি আটকাতে পারেনি বলে; যেতে বাঁধাও দেয়নি। শুধু পেছন থেকে তাঁকিয়ে দেখেছি নীরবে তার চলে যাওয়া। সেই হেঁটে যাওয়া রাস্তায় আজ চোখ পড়লে হৃদয় গভীরে আচমকা কষ্টের ঢোল বাঁজে। এটাই ভালো ছিল, কেন তুমি উদয় হলে আমার জীবনে? এ প্রশ্নটা প্রশ্নই থেকে গেল।
নিগার,
নিজ থেকে আসলে নিজ থেকে চলে গেলে। কোথায় ছিল আমার ভুল। তোমার ইচ্ছায় শতশত মাইল আমি পাড়ি দিয়েছি, কান্ত হয়নি। রাতের গভীরে অজানা শহরে নিজেকে উৎসর্গ করেছি, ভয় পাইনি। আমি তোমার আঙ্গিনায় আসতে রাত ১টা বেঁজে গেছে, তুমি কেন ঘুমাওনি? জবাবে বলে ছিলে, তুমি কুমিল্লা থেকে ময়মনসিংহে আসবে আর আমি ঘুমিয়ে থাকবো, আগে হোটেলে উঠো, তারপর আমি ঘুমাবো। সেই দিন বন্ধুত্বের যে মহান উদাহরণ তুমি আমার সামনে মেলে দিলে, আমিও বুঝে নিলাম এরই নাম বন্ধু ও বন্ধুতা।
যতবার তোমার আঙ্গিনায় আমি পা রেখেছি, ততবার নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। একটা ছাতার নীচেই তো আমাদের ঠাঁই হয়েছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে নিজেকে ভিজালেও আমাকে ভিজতে দেওনি। ব্রহ্মপুত্র নদের হিমেল ঠান্ডা হাওয়া তোমার লম্বা চুলের খোঁপা বাঁধা ‘বেনী’ না উড়লেও মুখের চারদিকে ছোট ছোট চুলগুলো আলপনা এঁকে ছিল, আমি শুধু তাকিয়ে দেখেছি। আর মনের গভীরে তার ছবি এঁকেছি। বৃষ্টিভেজা ঘাসের উপর গোলপাতার পাটি ছড়িয়ে পাশাপাশি বসে বলেছিলাম, জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে বয়ে যাওয়া নিষ্ঠুর স্রোতের কথা, বলেছিলাম সাতরাতে সাতরাতে আমার দেহের মেরুদন্ডটা বাঁকা হয়ে গেছে। এটা আর সোঁজা করতে চাই না। যদি আবার ভেঙ্গে যায়। জবাবে, তুমি বলেছিলে, আমি আছি; থাকবো। এখান থেকে নতুন করে শুরু করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এই জানো, ঐসব কথা আজ আমার রুমের আলমারিতে সাঁজিয়ে রাখা আসবাবপত্র। মাঝে মাঝে রংধনুর মতো পূর্বাকাশে উকি মেরে কালো মেঘের আড়ালে পালিয়ে যায়। ২০দিনের স্থলে ১৭দিন ছুটি কাটিয়ে এসে বলেছিলে, ১৭ বছর পার করে এসেছি, তোমার সাথে কথা না বলে একরাতও ঘুমাতে পারিনি। আবার তুমিই বললে, আমাকে ভুলে যাও, আমি আর পারছিনা। বিউটি পালারের রুপচর্চার আড়ালে নিজেকে নিয়ে গেলে মুহুর্তের মধ্যে। প্রশ্ন করে ছিলাম, আমি তো নিঃশেষ হওয়া একটা বস্তু এটা কি আর নিঃশ্বাস নিতে পারবে, বায়না ধরেছিলে, ‘তোমাকে পারতে হবে’, পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি পারবে, জবাবে বলেছিলে, ‘মেয়েরা অনেক কিছু পারে; তাদের অনেক কিছু পারতে হয়’। 
যে ভালোবাসার আবরণে তুমি আমাকে ঢেকেছিলে; আমি তাকে হারাতে চাইনি বলে, তুমি যা চেয়েছো তাই করেছি। নিজেই অন্যের হাতে আমাকে তুলে দিলে, ঘর-সংসার সাজানোর জন্য বললে, আমাকে দূরে থাকতে বললে। যথারীতি নিরবতা পালন করেছি, শুধু তোমাকে ভালোবাসি বলে। হারাতে চাইনি বলে দু’হাত জোড় করে বলেছিলাম, শুধু বন্ধুতা থাকুক, শুধু বন্ধুত্ব।
আমি বিশ্বাস করি, বন্ধু মানে একটি মানুষের পরিবর্তনের চাবিকাঠি। এরিস্টটল বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের নাম নাকি বন্ধুত্ব। আমি বিশ্বাস করি বন্ধুত্ব মানে আত্মার আত্মীয়, পরস্পরের মাঝে সহযোগিতা, বন্ধুত্ব মানে বিপদে পাশে থাকা, সুখে দুঃখে এক হওয়া। জীবনের নির্দিষ্ট কোনো বাঁকে নয়, বন্ধুত্বের ব্যাপ্তি সারাজীবনের সর্বণের। বন্ধুত্বকে পরিমাপ করা যায় না, করার দরকারও হয় না। কারণ বন্ধুত্ব হচ্ছে আঁধার রাতে প্রদীপ জ্বালানো আলো। শুধু নিজের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-কে নিজের দেহ-মন-অন্তর থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম বন্ধুতা। দু’হাত জোর করে বলেছিলাম, আর কোনদিন এ হৃদয়ে ভালোবাসার জন্ম দেব না; শুধু তোমার সাথে বন্ধুত্ব থাকুক। তুমি একাত্মচিত্রে গ্রহণ করে নিলে। শত কষ্টের মাঝে এক পশলা চোখের পানির মাঝে রংধনুর আবিরভাব হলো। নিজেকে ঘুটিয়ে নিলাম। শুধু বন্ধুত্বা আর বন্ধুত্বে।
কিভাবে নাটক সাজালে তার নাট্যকার তো তুমিই। আমি আর কি বলবো। বছরের পর বছর তোমার মোবাইল ফোন যখন বাঁজতে থাকে, তখন আমাকে একটি প্রশ্নই স্তব্ধ করে দেয়। ‘মেয়েরা সব পারে; তাদের অনেক কিছু পারতে হয়’।    
তারপরও প্রশ্নজাগে- আর কতকাল খোঁজবো তোমায়?

ইতি
চেনার মাঝে অচেনা অতিথি 
নাজমুল করিম ফারুক